পুরীর জগন্নাথধাম দেশের চার ধামের মধ্যে অন্যতম। বৈষ্ণবদের কাছে জগন্নাথদেব ভগবান শ্রীবিষ্ণুর এক রূপ। যেখানে ভগবান বিষ্ণু তাঁর স্ত্রী লক্ষীকে সাথে নিয়ে সকল ভক্তকে শ্রী বা সম্পদ দান করেন। তাই পুরীকে শ্রীক্ষেত্র বলা হয়। পুরী হল শ্রীচৈতন্যদেবের লীলাক্ষেত্র। বৈষ্ণবদের কাছে অতি পুণ্য তীর্থভূমি। কিন্তু এটা অনেকেই জানেন না পুরী কিন্তু ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক শক্তিপীঠ এবং তন্ত্রপীঠ। কারণ, জগন্নাথদেবকে শাক্ত এবং শৈবরাও মহাশক্তির আধার হিসেবে পুজো করেন।
জগন্নাথ অর্থাৎ জগতের নাথ। শ্রীক্ষেত্র পুরীর মন্দিরে তেত্রিশ কোটী দেবতার বাস। তাই চার ধামের মধ্যে সবচেয়ে উঁচুতে পুরীর স্থান। বৈষ্ণব তীর্থক্ষেত্র হলেও সবচেয়ে বড় কথা জগন্নাথধামেই রয়েছে সতীপীঠ। তন্ত্রমতে পুরী অন্যতম সিদ্ধপীঠও বটে। এখানে সাধনা করলে সিদ্ধিলাভ সহজেই হয় বলে বিশ্বাস। সতীপীঠ পুরীতে দেবীর রূপ বিমলা এবং তাঁর ভৈরব হলেন স্বয়ং জগন্নাথদেব। সাধারণত দেশের অন্যান্য সতীপীঠে অবস্থানকারী দেবীদের ভৈরব হলেন স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব। একমাত্র ব্যতিক্রম পুরী, এখানে দেবী সতীর ভৈরব শ্রী জগন্নাথ। দেবীপুরাণ মতে, এখানে সতীর দুটি পা পড়েছিল, অন্যমতে নাভি। পীঠনির্ণয়’ বা ‘মহাপীঠনির্ণয়’ গ্রন্থেও শ্রীক্ষেত্র বা বিরজাক্ষেত্র পুরীকে শক্তিপীঠ বলে উল্লেখ রয়েছে। আবার কুব্জিকাতন্ত্র অনুযায়ী আবার বিমলা ৪২টি সিদ্ধপীঠের একটি। দেবী বিমলা দশমহাবিদ্যার অন্যতম এক তান্ত্রিক দেবী। ফলে বৈষ্ণব তীর্থক্ষেত্র হলেও পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ভিতর অবস্থিত বিমলা মন্দিরে তন্ত্রমতে পুজো হয় আজও।
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত বিমলা মন্দির। এই মন্দির চারটি অংশে বিভক্ত। প্রথমটি, বিমান অর্থাৎ গর্ভগৃহের অংশ। দ্বিতীয়টি, জগমোহন বা সভাকক্ষ। তৃতীয়টি, নাট মণ্ডপ বা উৎসব কক্ষ। চতুর্থটি, ভোগ মণ্ডপ বা ভোগ নিবেদনের কক্ষ। শক্তি উপাসকদের কাছে দেবী বিমলা হলেন জগন্নাথদেবের তান্ত্রিক পত্নী এবং গোটা জগন্নাথ মন্দিরের রক্ষাকর্ত্রী। অলৌকিক শক্তির আধার পুরীর মন্দিরে অধিষ্ঠিত শ্রী জগন্নাথ বৈষ্ণবদের কাছে স্বয়ং বিষ্ণু, শৈবদের কাছে জগন্নাথ আসলে শিবারই রূপান্তর এবং শাক্তদের কাছে আদ্যাশক্তি বিমলার ভৈরব। অন্য একটি মতে, জগন্নাথ হলেন ভগবান বিষ্ণু, বলভদ্র হলেন স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব এবং সুভদ্রা হলেন আদ্যাশক্তি মহামায়া। সবমিলিয়ে পুরী যুগ যুগ ধরে এক অজানা রহস্য বয়ে বেরাচ্ছে ভক্তদের সম্মুখে।
ইতিহাস বলছে, পুরীর মূল জগন্নাথ মন্দিরের ভিতরে অবস্থিত বর্তমান বিমলা মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টিয় নবম শতাব্দীতে, আর আদিমূর্তিটি আরও প্রাচীন, সেটি তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতকে। মনে করা হয়, প্রাচিন এই মন্দিরটি নির্মান করিয়েছিলেন দক্ষিণ কোশলের সোমবংশীয় রাজা যযাতি কেশরী। তবে সেই মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তী সময় সেই ধ্বংসাবশেষের ওপরই বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়। ঐতিহাসিকরা বলেন, সম্ভবত এটিই ছিল পুরীর মূল মন্দির এবং জগন্নাথ মন্দিরের থেকেও প্রাচিন। খ্রিস্টিয় অস্টম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য পুরীতে দেবী বিমলাকে আদিশক্তির রূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর আলেখ্য অনুযায়ী এককালে পুরী ছিল ব্রক্ষ্ণা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরে এই ত্রিমূর্তি পুজোর প্রধান কেন্দ্র। সেই সঙ্গে তিন আদি শক্তি সরস্বতী, লক্ষ্ণী এবং পার্বতীর পুজোও হতো। দেবী বিমলাকেই পার্বতী রূপে পুজো করা হতো। তবে পরবর্তীকালে খ্রিস্টিয় সপ্তদশ শতকে বৈষ্ণবদের প্রভাব বিস্তার হওয়ায় পুরীতে শাক্ত এবং শৈব উপাসকদের প্রভাব কমতে থাকে। তবে সেটা এখনও পুরোপুরি লুপ্ত হয়নি।
বেশ কয়েকটি প্রাচীন কিংবদন্তী অনুযায়ী, বর্তমান জগন্নাথ মন্দির যেখানে, অতি প্রাচীনকালে সেই এলাকা ছিল দেবী বিমলার পীঠ। এক কিংবদন্তী অনুযায়ী, শবর রাজা বিশ্বাবসুর অরণ্যগুহা থেকে নীলমাধমের ইচ্ছে হয়েছিল রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের নগরে অধিষ্ঠিত হওয়ার। সেই ইচ্ছার স্বপ্নাদেশ পেয়েই রাজা ইন্দ্রদুম্নের দূত বিদ্যাপতি অরণ্যের গভীরে নীলমাধবকে খুঁজে বের করেন। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী জগন্নাথের দারুমূর্তি তৈরি করেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। কিন্তু রাজা মুসকিলে পড়েন এই ভেবে যেখানে স্বয়ং সতী অধিষ্ঠিত, যেটি এক সিদ্ধ সতীপীঠ। সেখানে জগন্নাথকে কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। কথিত আছে দেবী বিমলাই রাজা ইন্দ্রদ্যম্নুকে স্বপ্নে জানিয়েছিলেন, স্বয়ং জগন্নাথ এখআনে অধিষ্ঠিত হতে চেয়েছেন, এর থেকে আহ্লাদের বিষয় কি হতে পারে। আমি আমার পীঠমন্দির নিয়ে একপাশে সরে যাব। তুমি ধুমধাম করে তাঁকে (জগন্নাথদেব) প্রতিষ্ঠা করো সেই স্থানে।
কিংবদন্তী অনুসারে, এরপরই ঘটেছিল এক অলৌকিক ঘটনা। দেবী বিমলার পীঠমন্দির বেশ কিছুটা সরে যায় পবিত্র রোহিনী কুণ্ডের পশ্চিম তীরে। স্বপ্নে দেবী এও বলেছিলেন, জগন্নাথ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁকে যে ভোগ দেওয়া হবে, তাঁর উচ্ছিষ্টই যেন তাঁকে নিবেদন করা হয়। তা হলেই তিনি খুশি হবেন। সেই থেকে আজও জগন্নাথদেবকে ভোগ দেওয়ার পর সোনার থালা-বাটিতে সেই ভোগের একটি অংশ মা বিমলাকে নিবেদন করা হয়। এরপর সেটিই বাকি প্রসাদে মিশিয়ে মহাপ্রসাদ হিসেবে ভক্তদের বিলি করা হয়। এটাই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।
Discussion about this post