পরিবেশ দূষণ নিয়ে আজ পর্যন্ত যত আলোচনা হয়েছে, তার মধ্যে নিঃসন্দেহে প্রথমসারিতে থাকবে প্লাস্টিক দূষণ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল যে কোনও নির্বাচিত সরকার অথবা সাধারণ মানুষ, এই প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। যদিও ভারত সরকার ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর আইন করে সারা দেশে ১২০ মাইক্রনের কম পুরু প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আইন আইনের খাতায় রয়ে গিয়েছে। সেটা কার্যকর করা বা কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও উদ্যোগ দেখা যায় না ভারতে। তবে শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্বেই প্লাস্টিক দূষণ একটা বড় ব্যাধি হিসেবে উঠে আসছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মানুষের বীর্যেও পাওয়া গিয়েছে ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা।
প্লাস্টিক সহজে ধ্বংস হয় না। তাই যুগের পর যুগ ধরে জল, মাটিতে রয়ে যায়। তবে সবচেয়ে ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা, যা আকারে ৫ মিলিমিটারের কম। যা একটি পেন্সিলের ডগার আকারের থেকেও ছোট। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজমান। মাইক্রোপ্লাস্টিক বিভিন্ন উৎস থেকে আসে। এরমধ্যে অন্যতম হল, বড় প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষ বা ছোট ছোট টুকরো। এছাড়া আরেকটি উৎস মাইক্রোবিড, এটি এক ধরণের পলিথিন প্লাস্টিকের খুব ছোট টুকরো যা মূলত হেলথকেয়ার, বিউটি প্রোডাক্টগুলিতে থাকে। পাশাপাশি ক্লিনজার, টুথপেস্টেও ব্যবহৃত হয়। এই মাইক্রোবিডের ক্ষূদ্র কণাগুলি মূলত জলের সাথে মিশে নিকাশি নালা হয়ে নদী এবং মহাসাগরে গিয়ে পৌঁছয়। যা জলজ জীবনের ক্ষেত্রে একটা বড় হুমকি।
অপরদিকে, এই মাইক্রোবিডস বা মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা, একদিকে যেমন জলজ প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করছে, ঠিক তেমনই তা স্থলভাগের অন্যান্য প্রাণী এবং মানুষের শরীরেও প্রবেশ করছে। এটাকে নিঃশব্দ ঘাতক বলে উল্লেখ করছেন বিজ্ঞানীদের একাংশ। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে এক ভয়ানক তথ্য। চিন, ইতালির মতো বেশ কয়েকটি দেশে বিবাহপূর্ব স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় সুস্থ পুরুষদের বীর্যে পাওয়া গিয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। যা খুবই উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। উল্লেখ্য, বিগত কয়েক দশক ধরেই পুরুষদের শুক্রাণুর সংখ্যা কমছে। লক্ষ্য করা গিয়েছে, প্রায় ৪০ শতাংশ পুরুষের ক্ষেত্রে বীর্যের পরিমান কমে যাওয়ার প্রমান পাওয়া গিয়েছে। অথচ তাঁরা শারীরিকভাবে সুস্থ। চিনের জিনানে ৪০ জন সুস্থ পুরুষের বীর্ষের নমুনা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, সকলেরই বীর্ষে মিশে রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। চিনের অন্য একটি অঞ্চলে ২৫ জনের নমুনায় অর্ধেকের বেশি পুরুষের বীর্ষে পাওয়া গিয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। আবার ইতালির প্রতি দশজন পুরুষের মধ্যে ৬ জনের বীর্যে পাওয়া গিয়েছে ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক।
ইঁদুরের উপর গবেষণায় দেখা গিয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক শুক্রাণুর সংখ্যা হ্রাস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহন করে। এটি শরীরে হরমোনের ব্যালান্সে ব্যাঘাত ঘটায়। এরপরই মানবশরীরের উপর মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। দি গার্ডিয়ান পত্রিকার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসেই এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ২৩ জন মানুষের বীর্ষে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। উল্লেখ্য, ওই ২৩ জনের নমুনাই পরীক্ষা করা হয়েছিল গবেষণায়। ওই গবেষণায় ৪৪টি কুকুরের বীর্ষও পরীক্ষা করা হয়েছিল, যাদের সবকটিতেই মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে। মানব শরীরের উপর মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব নিয়ে গবেষণা যত এগোচ্ছে, ততই উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। যেমন, শুধু মানুষের বীর্যেই নয়, মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে, রক্ত, প্লাসেন্টা, মাতৃদুগ্ধ সবেতেই। যা মানুষের দেহে ব্যাপকভাবে দূষণের ইঙ্গিত দেয়। এমনকি মানব কোষ এবং হরমোনের ক্ষতিও করতে পারে বলেই অনুমান বিজ্ঞানীদের। মানুষের স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব এখনও পুরোপুরি আবিস্কার হয়নি। তবে এর ক্ষতিকর প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী সেটা না বললেও চলে।
প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে মিশছে। যার বেশিরভাগটাই মাইক্রোপ্লাস্টিকে ভেঙে যায়। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক তথ্য হল, পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্ঘ মাউন্ট এভারেস্ট থেকে শুরু করে মহাসাগরের গভীরতম অংশ, সর্বত্র মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। যা আমাদের প্রিয় এই গ্রহকে সামগ্রিকভাবে দূষিত করছে। আর এই মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা জল এবং খাবারের সঙ্গে মিশে অথবা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে মানবশরীরে প্রবেশ করছে। চিনের কিংডাও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নিং লি জানিয়েছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে নতুন নতুন গবেষণা প্রমান করছে কিভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানব স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে। যা মানুষের স্বাস্থ্য এবং স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়াকে সরাসরি ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মাইক্রোপ্লাস্টিক মানব প্রজননের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যা পুরুষদের শুক্রাণুর বৃদ্ধি হ্রাস করে অথবা বিকৃতি করে প্রজনন ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা মানবশরীরের জন্য একটা দীর্ঘস্থায়ী এবং ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি হিসেবে পরিগনিত হচ্ছে।
সায়েন্স অফ দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে আটটি ভিন্ন প্লাস্টিক শনাক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে বেশি ক্ষতিকর প্যাকেজিংয়ের জন্য ব্যবহৃত পলিস্টাইরিন, পলিথিন যা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে ব্যবহার হয় আর পিভিসি, যা পাইপ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এই ধরণের প্লাস্টিক ভেঙে যে মাইক্রোপ্লাস্টিক কনার সৃষ্টি হয়, সেগুলি কোষের প্রদাহের অন্যতম কারণ। এগুলি বায়ুদূষণ এবং জল দূষণের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের রক্তনালীতে প্রবেশ করে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের মতো ঝূঁকি সৃষ্টি করে। ফলে বিজ্ঞানীরা জাতিসংঘ এবং বিশ্বের প্রথমসারির দেশসমূহকে বারবার সাবধানবানী শোনাচ্ছেন যাতে প্লাস্টিকের ব্যবহার হ্রাস করা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখনও বেশরভাগ দেশই আইন প্রনয়ন করা ছাড়া বড় কোনও পদক্ষেপ গ্রহনই করেনি। আমেরিকা ২০১৫ সালে স্বাস্থ্য এবং বিউটি প্রোডাক্টে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। তবে তৃতীয় বিশ্বের কতগুলি দেশে এমন কোনও আইন আছে কিনা সেটাই সন্দেহ। ফলে খুব সহজেই মাইক্রোপ্লাস্টিক মানব শরীরে প্রবেশ করছে, আর পুরুষদের শুক্রাণু বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করছে। যা আগামীদিনে এক ভয়াবহ পরিনতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
Discussion about this post