একেই বলে ইটের জবাব পাটকেলে দেওয়া। বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারত এখনও পর্যন্ত কড়া কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এমনকি বাংলাদেশ থেকে ক্রমাগত হুমকি, উস্কানিমূলক প্ররোচনা এলেও ভারত আশ্চর্যজনকভাবে নীরব থেকেছে। যা নিয়ে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ও কূটনৈতিক মহলের একাংশ কড়া সমালোচনা করতে ছাড়েনি নরেন্দ্র মোদি সরকারকে। তবুও নীরব ভারত সরকার। তবে ভারত পুরোপুরি নীরব রয়েছে সেটা বলা যাবে না। কারণ বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্তরে একের পর এক যে জবাব দেওয়া হচ্ছে, সেটা সরব হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি। বেশ কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বোঝা যাবে।
বুধবার ঢাকাতে অবস্থিত বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটি রীতিমতো বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল। ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার ৩২ নম্বর বাড়িটি বাংলাদেশের জাতীয় স্মারক বা সংগ্রহশালা হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এই বাড়িটির যোগ অত্যন্ত নিবিড়। কিন্তু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং এক শ্রেণীর উগ্রপত্র পন্থী মৌলবাদী সংগঠন রাতের অন্ধকারে গোটা বাড়িটি ধুলোয় মিশিয়ে দিল। আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশ সরকার এর দায় ঠেললো ভারতের দিকেই। যা ভারত সরকার কোনভাবেই মেনে নেয়নি। ভারত সরকার এই ঘটনার তীব্র নিন্দাই শুধু করেনি। বরং ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের তরফে শেখ মুজিবের বাড়িটিকে ঐতিহাসিক আখ্যা দিয়ে বলা হল, ওই বাড়িটি ছিল বাংলাদেশে দখলদারি এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের সাহসী প্রতিরোধের একটি প্রতীক, যা বুধবার ধ্বংস করা হয়েছে।
এর আগে মুহম্মদ ইউনূস সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটিকে উন্মত্ত জনতার ভেঙে ফেলার ঘটনাকে অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত বলেছিল। সেই সঙ্গে এও বলা হয়েছিল যে, শেখ হাসিনার ‘সহিংস আচরণের প্রতিক্রিয়া’-তেই ভাঙচুর করা হয়েছে মুজিবের বাড়িতে। অর্থাৎ ঢাকার দাবি, ভারতে বসে শেখ হাসিনা জুলাইয়ের গণআন্দোলন নিয়ে যে ‘প্ররোচনামূলক’ মন্তব্য করেছেন, তারই প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের উপর। এমনকি হাসিনা যাতে ভারত থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে বক্তৃতা করতে না-পারেন, নয়াদিল্লিকে তা নিশ্চিত করতে লিখিত অনুরোধও করেছে ঢাকা। পাশাপাশি বৃহস্পতিবার সকালেই তলব করা হয়েছিল ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় উপরাষ্ট্রদূতকেও। এরই জবাব দিয়েছে নয়া দিল্লি।
বৃহস্পতিবার বিকেলে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের তরফে সংবাদ মাধ্যমকে জানানো হয় ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া হিসাবে বলা হয়, ভারত মনে করে, এটি দুঃখজনক যে, ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাসভবন, যেটি ধ্বংস করা হয় সেটি বাংলাদেশে দখলদারি এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের সাহসী প্রতিরোধের একটি প্রতীক ছিল। তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার রাতেই দলের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে মুজিবের বাড়ির ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেন, ওই বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ওই বাড়িতেই তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, নয়া দিল্লি কার্যত পাত্তাই দিল না বাংলাদেশের আর্জি। যেখানে বাংলাদেশের তদারকি সরকার রীতিমতো চিঠি পাঠিয়ে ভারতকে বলেছিল হাসিনার মুখ বন্ধ করুন। সেখানে ভারত সরকার পাল্টা জবাবে বুঝিয়ে দিল, বাংলাদেশে যা যা হচ্ছে সেটা ঠিক হচ্ছে না। এমনকি ভারতের বিবৃতিতে হাসিনার সম্পর্কে একটি শব্দও উল্লেখ নেই। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের এই কড়া জবাব পেয়েই ইউনূস প্রশাসন বুঝে গিয়েছে তাঁদের আর্জি মানবে না ভারত। বরং গোটা ঘটনায় নাক পুড়েছে বাংলাদেশের। এরপরই নড়েচড়ে বসে ইউনূস প্রশাসন। তদারকি সরকারের তরফে বৃহস্পতিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের সমাজমাধ্যমে একটি বিবৃতি পোস্ট করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে, কতিপয় ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর চালানো এবং অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ড সরকার শক্ত হাতে প্রতিহত করবে। অপরদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বাংলাদেশের জনতার উদ্দেশে লিখেছেন, ‘‘থামুন। শান্ত হোন। সরকারকে কাজ করতে দিন। বিচার ও সংস্কার হবেই। আপনারা গালি দিলেও বলব, থামুন। রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের মতে, বিশ্ব মঞ্চে এই ঘটনার প্রভাব বাংলাদেশের পক্ষে নেতিবাচক এটা উপলব্ধি করছে তদারকি সরকার। সেই সঙ্গে ভারতকে চিঠি দিয়েও যে জবাব এসেছে তাতে মুখ পুড়েছে সরকারের। সবমিলিয়ে তড়িঘড়ি ডামেজ কন্ট্রোলে নামলো ইউনূস ও তাঁর সরকারের মাস্টারমাইন্ড মহফুজ আলম।
Discussion about this post