বিগত দশ মাসে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক সবচেয়ে তলানিতে এসে ঠেকেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তরবর্তীকালীন সরকার ভারত থেকে যতটা দূরে থাকা যায় সেটাই করে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে তাঁরা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশ বাড়িয়ে চলেছে। একটা দেশ, তাঁরা কোন কোন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করবে, বা কাদের থেকে দূরত্ব তৈরি করবে সেটা সেই দেশের কূটনীতির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সাধারণত প্রতিবেশিদেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা কূটনৈতিক দিক থেকে একটা সফল প্রয়াস হিসেবে গণ্য হয়। এর উল্টোটাও আছে। যেমন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক চিরকালই বৈরিতার। এর উন্নতি বা অবনতির কোনও অবকাশ ছিল না। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অতি মধুর ও বন্ধুত্বের। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই করেই জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের, যা ভারতের সামরিক অভিযানের ফসল। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারত বিরোধিতা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। যা নয়া দিল্লি মোটেই ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু যখন ইউনূস ভারতের সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ক্রমাগত হুমকি দিতে শুরু করলেন তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি , বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সূত্রের খবর এবার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আরও বড় পদক্ষেপ নিতে চলেছে ভারত।
পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার পরবর্তী সময়ে ভারত সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করেছিল। যা আজও বহাল আছে। সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত হওয়ায় ভারত পাকিস্তানে সিন্ধু নদীর জলপ্রবাহ আটকে দিয়েছে। ফলে পাকিস্তান এখন জলের জন্য হাহাকার করছে। এবার ভারত আরও একটি বড় সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে, আর সেটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গা নদীর জলবন্টন চুক্তি নিয়ে বড় সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে ভারত সরকার, যা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা বাকি।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর জলবন্টন চুক্তি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। সেই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ডঃ মনমোহন সিং আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। ৩০ বছর মেয়াদের এই চুক্তি শেষ হচ্ছে ২০২৬ সালে, অর্থাৎ আগামী বছর। সূত্রের খবর নয়াদিল্লি চাইছে গঙ্গা জল বন্টন চুক্তি নতুন করে সম্পাদন করতে। এর জন্য ঢাকাকে চাপ দেওয়া শুরু করেছে নয়া দিল্লি।
বর্তমান গঙ্গা জলবন্টন চুক্তি অনুযায়ী যে কোনও সংকটের সময় বাংলাদেশকে ৩৫,০০০ কিউসেক জল সরবরাহ করার গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের ফাক্কায় বাঁধ নির্মাণ করে গঙ্গার জল প্রবাহ দুই দেশের মধ্যে ভাগ করা হয়। ফারাক্কা বাঁধ থেকে ফিডার ক্যানাল মারফত হুগলি নদীতে জল পাঠানো হয়, আর গঙ্গার মূল প্রবাহ বাংলাদেশে প্রবেশ করে পদ্মা নাম নিয়ে বয়ে গিয়েছে। বর্তমান নরেন্দ্র মোদি সরকার এবার সিন্ধু জল চুক্তির মতোই গঙ্গা জল বন্টন চুক্তি নিয়ে এগোতে চাইছে। জানা যাচ্ছে ভারত ইতিমধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে জানিয়ে দিয়েছে যে, নিজেদের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নমূলক চাহিদা মেটাতে গঙ্গার জলের বৃহত্তর অংশের প্রয়োজন। এবং সেই অনুযায়ী চুক্তিটি নবিকরণ করা হবে। বিভিন্ন সূত্র দাবি করছে, ভারত অতিরিক্ত ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কিউশেক জল চাইছে। অর্থাৎ ফারাক্কা থেকে গঙ্গার জলের প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ হাজার কিউশেক জল এবার ভারত নেবে আর বাকিটা বাংলাদেশ পাবে।
পাশাপাশি নতুন চুক্তির মেয়াদ কম হবে বলেও মনে করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত ১০ থেকে ১৫ বছরের জন্য চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের সূত্রে জানা যাচ্ছে, ঘটনার আগে, পহেলগাঁও হামলার আগে পর্যন্ত আরও ৩০ বছরের জন্য চুক্তি নবায়নের দিকে ঝুঁকছিল ভারত। সেই অনুযায়ী আলাপ আলোচনাও শুরু হয়েছিল দুই দেশের মধ্যে। কিন্তু এরপর পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়, সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করা যার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। জানা যাচ্ছে যে, ফারাক্কা ব্যারেজটি মূলত ৪০,০০০ কিউসেক জলের অবিচ্ছিন্ন প্রবাহকে একটি ফিডার খালে পাঠিয়ে দেয়। যা কলকাতা বন্দর ট্রাস্টের জন্য জন্য তৈরি করা হয়েছিল। গঙ্গায় ফারাক্কা পয়েন্টের আগে ও পরে শুষ্ক মৌসুমে জলের প্রবাহ কতটা বজায় আছে, সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান কী বলছে, গঙ্গার জলপ্রবাহের কতটা পদ্মায় আর কতটা ভাগীরথী বা হুগলী নদীতে যাচ্ছে, এই বিষয়গুলো নিয়ে টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠকে চুলচেরা আলোচনা হয়ে থাকে। কিন্তু গত মার্চে একদফা আলোচনার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এবার ভারত চাপ দিচ্ছে নিজের জন্য বেশি জল রেখে বাকি জল বাংলাদেশকে দেওয়া হবে। এখন দেখার মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার এর কী প্রতিক্রিয়া দেয়। উল্লেখ্য, সম্প্রতি সিন্ধু জল চুক্তি প্রসঙ্গে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর যেমন বলেছেন, প্রতিবেশী দেশগুলির বোঝা উচিত, ভারতের সঙ্গে কাজ করলে তারা লাভবান হবে ৷ আর তা না-হলে তাদের মূল্য চোকাতে হবে। তাঁর লক্ষ্য যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ, এটা নিশ্চই বলে দিতে হবে না।
Discussion about this post