উত্তরাখণ্ড রাজ্যের কুমায়ুন রেঞ্জে কাশ্যপ পাহাড়। এই পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে এক অতি সাধারণ মন্দির। যাকে স্থানীয়রা বলেন কাঁসার দেবী মন্দির। বিশ্বাস, এই কাঁসার দেবী মা দুর্গার এক রূপ। ঐতিহাসিকগণের দাবি, মন্দিরটি হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে নির্মিত। কিন্তু এই অতি সাধারণ দেখতে মন্দিরটি কিন্তু যুগ যুগ ধরে এক অপার রহস্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। প্রথমে এক গিরিশরার গুহায় ছিল মূল মন্দির, পরবর্তী সময় বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ হয়। কিন্তু এই মন্দিরেই বিভিন্ন সময় পা রেখেছিলেন মহান সব ব্যক্তিত্ব। স্বামী বিবেকানন্দ থেকে শুরু করে বব ডিলান, জর্জ হ্যারিসন, ক্যাট স্টিভেন্স, আনন্দময়ী মা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু কেন তাঁরা ছুটে এসেছিলেন আপাত নিরীহ এই মন্দিরে? কেনই বা এই মন্দিরে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বিজ্ঞানীরা? কারণ এই মন্দির ও আশেপাশের পাহাড়ে রয়েছে উচ্চ চৌম্বকীয় ক্ষেত্র।
১৯৫৮ সালে আইওয়া ইউনিভার্সিটির মহাকাশ বিজ্ঞানী জেমস ভ্যান আলেন আবিষ্কার করেছিলেন পৃথিবীকে ঘিরে থাকা দুটি অতি উচ্চ ক্ষমতাশালী তেজস্ক্রিয় বলয়। যেগুলির নাম দেওয়া হয়েছিল। যা ভ্যান অ্যালেন বেল্ট’ (van allen belt) নামে খ্যাত। নাসার বিজ্ঞানীরা এই বেল্ট দুটি বলয় তৈরি করে সৌর ঝড় ও নানান মহাজাগতিক কণা থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে। নাসার বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন পৃথিবীর তিনটি জায়গায় এই ভ্যান অ্যালেন বেল্ট অবিশ্বাশ্য প্রভাব ফেলে। সেই তিন জায়গা হল পেরুর প্রাগৈতিহাসিক স্থান মাচু পিচ্চু, ইংল্যান্ডের প্রাগৈতিহাসিক মনুমেন্ট স্টোনহেঞ্জ এবং ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের কুমায়ুনে অবস্থিত কাশ্যপ পর্বত, যেখানে অবস্থিত কাঁসার দেবী মন্দির।
এই মন্দিরে যুগ যুগ ধরে স্থানীয়রা মানসিক রোগের চিকিৎসা করাতে আসেন। এই মন্দিরের গর্ভগৃহে আছে ‘অখণ্ড জ্যোতি’। কবে থেকে এর আগুন জ্বলছে তা কারও জানা নেই। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই অখণ্ড জ্যোতি কুণ্ডের ছাই যে কোনও মানসিক রোগ সারিয়ে দেয়। আর ওই পার্বত্য অঞ্চলে বা কাঁসার দেবী মন্দির চত্বরে পৌঁছলে পাওয়া যায় অগাধ শান্তি। এই শান্তির খোঁজে ব্রিটিশ আমল থেকেই দলে দলে হিপিরা আসতেন এই মন্দিরে। ১৮৯০ সালে এই কাঁসার দেবী মন্দিরে এসেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি মন্দিরের কাছে থাকা একটি গুহায় ধ্যানমগ্ন হয়ে ছিলেন বেশ কিছু দিন। যা তিনি লিখেও গিয়েছিলেন পরবর্তী সময়। এখানে আসা বিশ্বের নানা দেশের শিক্ষাবিদ, মনস্তাত্ত্বিক, রহস্যপ্রেমী, গবেষক, দার্শনিক, সাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পীরা উপলব্ধি করেছিলেন স্থান মাহাত্ম। তাঁদের মনের সব চিন্তা দূর করে দিয়েছিল। অফুরান আনন্দ ও শান্তি ঘিরে ধরেছিল তাঁদের অশান্ত মনকে।
পরবর্তী কালে ২০১৩ সালে নাসার বিজ্ঞানীরা পুরো গিরিশিরাটি জুড়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তাঁরা আবিষ্কার করেন যে কাসার দেবীর মন্দির ও আশেপাশের এলাকা প্রচণ্ড শক্তিশালী এক ভূচৌম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থিত। যার সঙ্গে যোগাযোগ আছে পৃথিবীকে ঘিরে থাকা ভ্যান অ্যালেন বেল্টের। ফলে এই অঞ্চলে সর্বদা বিরাজ করে পজিটিভ এনার্জি।
আলমোড়া-বাগেশ্বর হাইওয়ে ধরে আলমোড়া থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাঁসার দেবী মন্দির। উচ্চতা প্রায় ৮৬০০ ফুট। পাইন দেবদারু গাছে ঘেরা শান্ত সিগ্ধ পরিবেশে এই মন্দিরের গর্ভগৃহ একটি প্রাচীন গুহা। এখানে বিরাজ করছে সিংহবাহিনী অষ্টভূজা মাতা কাসার দেবীর মূর্তি। মন্দির চত্বর থেকেই দেখা যায় শিবলিঙ্গ, পঞ্চচুল্লি, নন্দাদেবী, ত্রিশুল, চৌখাম্বা ও আরও কত চেনা অচেনা শৃঙ্গের। এখানকার অপার শান্তি যে মহাজাগতিক অদৃশ্য কণা থেকেই উৎপন্ন তা আজ প্রমাণিত। বিজ্ঞানীরা এটা প্রমান করার বহু আগেই তা উপলব্ধি করেছিলেন স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ।
Discussion about this post