১৮৬১ থেকে ১৯৪১, তাঁর জীবনের দীর্ঘ ৮০ বছরে তিনি ছিলেন অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঙালি যাকে বিশ্বকবি বলেই চেনে। তবে আরও বৃহত্তর অর্থে, বললে তিনি ছিলেন বিশ্ব মানবতার প্রতীক। রবীন্দ্রনাথের লেখা বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম এবং চিঠিপত্রের বিষয়বস্তু ঘাটলেই বোঝা যাবে তিনি দেশপ্রেমকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করতেন না। তার চেয়ে বরং বেশি প্রাধান্য দিতেন মানবতাকে। নিজের জীবনে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর সে কারণেই তিনি দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদের নামে মানবতার নিষ্পেষণ মেনে নিতে পারেননি। সেটা তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে লেখা একটা চিঠিতেই ব্যক্ত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দুটি বিশ্বযুদ্ধের মূলেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মুক্ত আস্ফালন। ফলে তিনি জাতীয়তাবাদের কঠোর সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘ঘরে বাইরে’, ‘চার অধ্যায়’
ও ‘গোড়া’ উপন্যাসেই তার প্রমান আছে। এছাড়া ন্যাশনালিজম ইন দ্য ওয়েস্ট বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথের গলায় শোনা গিয়েছে, “নেশনের একমাত্র বাসনা অবশিষ্ট পৃথিবীর দুর্বলতার সুযোগে ফুলে ওঠা এবং প্রতিবেশী সমাজগুলিকে গ্রাস করা। যার ফল হিসেবে গড়ে ওঠে পারস্পরিক ইর্ষা ও আতঙ্কের পরিবেশ”।
রবীন্দ্রনাথ বরাবরই মনে করতেন জাতীয়তাবোধের মধ্যেই ক্ষমতা, আধিপত্য ও সংগ্রামের বীজ লুকিয়ে আছে। যা মানবজাতি ও সমাজব্যবস্থায় ভিন্নতা সৃষ্টি করে আর ব্যক্তি স্বাধীনতাকে আহত করে। কবির দৃষ্টিতে জাতীয়বাদ হল মানবিকতার প্রতি ভীতি প্রদর্শন। আর মানুষের নৈতিকতা, অনুভূতি এবং ঐক্যবোধকে পদদলীয় করার উপায়। বর্তমান ভারতে এখন সেই উগ্র জাতীয়তাবাদের হাওয়া চলছে। ফলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থাকলে তিনি কি করতেন সেটা ভাবার সময় এসেছে। এই মনুবাদী দেশপ্রেমী ও জাতীয়তাবাদের মোকাবিলাও তিনি কিভাবে করতেন সেটাও এখন ভাববার বিষয়।
বর্তমান সময়ে বিজেপি দেশজুড়ে কার্যত উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচার করছে। আর বাংলায় এই প্রচারের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-সহ বিজেপি নেতারা রবীন্দ্রনাথকেই স্মরণ করছেন। প্রধানমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গুরুদেব বলে বন্দনা করে দেশবাসীকে বলছেন, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বা হিন্দুত্ববাদী। অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কবিগুরু কখনই নিজেকে সনাতনী হিন্দু বলে দাবি করতেন না। তিনি বরং রাজা রামমোহন রায়ের প্রবর্তিত ব্রাক্ষ্মসমাজের একজন প্রাণপুরুষ। তিনি মূর্তিপুজা বা প্রচলিত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে বিশ্বাসী ছিলেন না। জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেমের থেকে তিনি বরং মানবতাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। এমনকি তিনি তৎকালীন সময়ে মানবাধিকার সংগঠনও তৈরি করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে তাঁর লেখনীতে ঝলসে উঠেছিল একাধিক জ্বলন্ত কবিতা। আবার অসহযোগ আন্দোলনে সামিল হওয়ার জন্যও তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে ত্যাগ করেছিলেন ব্রিটিশদের দেওয়া নাইটহুট উপাধি। সে দিক থেকে বিচার করলে একটা দুষ্টু প্রশ্ন মাথায় আসতেই পারে, বর্তমান সময় যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থাকতেন, তাহলে কি তাঁরও ঠিকানা হতো জেলে?
Discussion about this post