বাংলাদেশের পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে পারে। এমনটাই আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক মহলের একটা বড় অংশ। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর এক ফেসবুক পোস্ট ঘিরে কার্যত উত্তাল পরিস্থিতি বাংলাদেশে। ওই পোস্টে হাসনাত দাবি করেছিলেন, সেনাবাহিনীর তরফে তাঁকে এবং তাঁর দুই সহযোদ্ধাকে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। এই পরিকল্পনা পুরোপুরি ভারতের। সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরিন শারমিন, তাপসকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। আমাদেরকে প্রস্তাব দেওয়া হয় আসন সমঝোতার বিনিময়ে আমরা যেন এই প্রস্তাব মেনে নিই। হাসনাতের এই দাবি সামনে আসার পরই তাঁর আরেক সহযোগী আসিফ মাহমুদ, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের তদারকি সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা তিনিও সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনেন। কিন্তু আচমকা কেন তাঁরা সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ নিয়ে এতটা তৎপর হল? এর পিছনে রহস্যটাই বা কি?
পিনাকী ভট্টাচার্যের নাম আপনারা প্রায় সকলেই শুনেছেন। বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে ফ্রান্সে বসেই তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ছাত্রনেতাদের নানামুখী নির্দেশ দিয়ে চলেন। তিনি এই জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃত্বকে বরাবর আন্দোলনের রূপরেখা দিয়ে আসেন। এবারও তাঁর অন্যথা হয়নি। বিগত কয়েকদিন ধরে তিনি ফেসবুক, ইউটিউবে ক্রমাগত সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের বিরুদ্ধে উস্কে যাচ্ছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগের কোন নেতাকে কোন পদে বসিয়ে রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ তৈরি হবে সেটাও ফেসবুকে ফলাও করে ছেপেছেন পিনাকী। তিনি লেখেন, “সাবের হোসেন চৌধুরী সভাপতি আর বডি সোহেল সাধারণ সম্পাদক এইভাবে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হবে। এই পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যাবে। এইটাই বিএনপি, ভারত ও ওয়াকারের যৌথ সিদ্ধান্ত।
এতে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বৃটেইনের সমর্থন আছে। এই কারণেই সাবের হোসেন চৌধুরীকে জেলে রাখা যায় নাই”। ওই পোস্টে ছাত্রদের ক্ষমতা সীমিত, এটা স্বীকার করে নিয়েও তিনি লেখেন, “আপনারা জানেন, আমি হাল ছাড়ি না। যতোদিন বেচে আছি বিপ্লবকে ব্যর্থ হতে দেবোনা। ১৯৭৫ এর পুনরাবৃত্তি হতে দেবোনা। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বা ভারতীয় আধিপত্যবাদ ফিরবে না; যতই তার পিছনে ওয়াকার থাকুক, সিভিল মিলিটারি বুরোক্রেসি থাকুক, প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার থাকুক আর বিএনপি থাকুক”। অর্থাৎ, অভিযোগের তির কাদের দিকে থাকবে তার দিক নির্দেশনা তিনি করেই দিয়েছেন। আর পিনাকীর বলে দেওয়া ফর্মুলা মেনেই জাতীয় নাগরিক পার্টি তাঁদের নতুন আন্দোলন শুরু করে দিল। সেটা হল আওয়ামী লীগকে কোনও ভাবেই বাংলাদেশের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে দেওয়া যাবে না। এখন প্রশ্ন হল, আওয়ামী লীগ যখন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ নয়, তাহলে এমন দাবি উঠলেই কি সরকার পিছিয়ে আসবে? সেনাপ্রধানই বা কেন চুপ করে থাকবে?
রাজনৈতিক মহলে তুমুল কৌতূহল তৈরি হয়েছে, হাসনাতের কথা সত্যি হয়ে থাকলে সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরীন শারমিন ও ফজলে নুর তাপসেদের বিষয়ে শেখ হাসিনা কি ওয়াকিবহাল? আওয়ামী লিগ কি ভেঙে যাচ্ছে? যদিও এই ব্যাপারে আওয়ামী লিগ নেতারা কোনও মন্তব্য করতে চাননি। যোগাযোগ করা হলে তাঁদের অনেকেই বলেছেন, শেখ হাসিনা দেশে কোনও নেতাকে দল পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন বলে তাঁদের অন্তত জানা নেই। রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের যে তিন নেতার নাম সামনে আসছে, ঘটনাচক্রে তিন নেতাই শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপস। পাশাপাশি তিনি আওয়ামী লিগ নেত্রীর আত্মীয় এবং যুব লিগের সভাপতিও ছিলেন। শিরীন শারমিন চৌধুরীকে হাসিনা প্রকাশ্যে ‘আমার মেয়ে’ বলে উল্লেখ করে থাকেন। আবার সাবের হোসেন চৌধুরীও নেত্রীর খুব ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। ফলে আদৌ হাসনাত বা পিনাকী যে সত্যি বলছেন, এ কখা হলফ করে কেউ বলতেই পারছেন না। কারণ এটা তাঁদের নতুন চাল হতে পারে শেখ হাসিনাকে বিভ্রান্ত করতে।
আর এই আবহে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাওয়া অসম্ভব নয় বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। তেমন পরিস্থিতি এড়াতে হলে সেনা শাসনই একমাত্র বিকল্প বলে অনেকেই মনে করছেন। বাংলাদেশের জনগণের একাংশ এখন সেই দাবিই তুলছেন। কিন্তু আওয়ামী লিগকে রাজনীতিতে ফেরানো নিয়ে আগেই আপত্তি তুলেছে দুই উগ্র ইসলামিক দল জামায়াতে ইসলামি এবং হেফাজতে ইসলাম। মূলত তাঁদের সূরেই সুর বেঁধেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। উগ্র ইসলামিক দলগুলি সেনাবাহিনীর উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দিয়েছে শেখ হাসিনার দলকে কোনও অবস্থাতেই রাজনীতিতে ফিরতে দেওয়া যাবে না। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলির কাছে খবর, লুট হওয়া অস্ত্রের বেশিরভাগই জামায়াতে ইসলামি, হেফাজতে ইসলাম, হিজব-উত তাহরির মতো উগ্র ইসলামিক দলগুলির নেতা-কর্মীদের হাতে আছে। গৃহযুদ্ধ শুরু হলে যাদের ঠেকানো কঠিন হবে। ফলে বাংলাদেশের একটা বড় অংশ মনে করছে, যত দ্রুত সম্ভব সেনাবাহিনীর উচিৎ, দেশের শাসনভার নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া। যাতে এই পরিস্থিতি এড়ানো যায়।
Discussion about this post