যাননি স্ত্রীর পারলৌকিক ক্রিয়ায়, একমাত্র ছেলেকে করেছিলেন ত্যাজ্যপুত্র, বাবা-মা হয়েছিলেন কাশীবাসী। যিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে হয়ে উঠেছিলেন আশির্বাদস্বরুপ, সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন অনেক যন্ত্রনায়। আজ থেকে ১৩৩ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন বাংলার নবজাগরণের প্রাণ পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসার। যিনি একাধারে শিক্ষানুরাগী, একাধারে সমাজসংস্কারক এবং দয়ার সাগর। তৎকালীন গোঁড়া সমাজের সঙ্গে অপরিসীম লড়াই বাল্য বিধবা রুখেছিলেন, পরে বিধবা বিবাহ প্রথা চালু করে নারীদের সমাজে উঁচু স্থান দিয়েছিলেন। নারী শিক্ষা প্রসারে তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। সেই সময় বহু মানুষ তাঁর পাঠানো টাকায় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে জিতেছিলেন। গরীব, দুঃখী মানুষদের মুখে দুবেলা দুমুঠো অন্ন উঠেছে। সেই মানুষটাই মৃত্যুর আগে ছিলেন একদম একা।
একসময় বিদ্যাসাগরকে শুধু সমাজের সঙ্গে লড়াই করতে হয়নি, লড়তে হয়েছিল নিজের পরিবারের সঙ্গেও। আর সেই লড়াই ছিল অনেক বেশি হৃদয় বিদারক। তাঁকে শুধু তাঁর একমাত্র পুত্র বা পরিবার আহত করেননি, ক্ষতবিক্ষত করেছিল সেই সময়কার শিক্ষিত সমাজ, ইংরেজ শাসকদের করুণালোঙী জমিদার বা বাবু সম্প্রদায়। এমনকি তাঁর জন্মদাতা পিতা এবং জন্মদাত্রী জননীও তাঁকে ছেড়ে কাশীবাসী হয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বেঁচেছিলেন ৭০ বছর। কিন্তু ১৮৭৫ সালে ৫৫ বছর বয়সেই তিনি সম্পত্তির উইল করেছিলেন। আর সেই উইলের পরতে পরতে ছিল বিদ্যাসাগরের অভিমান, কষ্ট-যন্ত্রণার জলছবি।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উইলে ছিল তাঁর সম্পত্তির তালিকা। তাঁর নির্দেশ ছিল, এই সম্পত্তি থেকে ৪৫ জন নরনারীকে নির্দিষ্ট হারে মাসিক বৃত্তি দেওয়ার। এরমধ্যে ২৬ জনই ছিলেন বিদ্যাসাগরের অনাত্মীয়। পাশাপাশি তাঁর প্রতিষ্ঠিত দাতব্য চিকিৎসালয়, মায়ের নামে স্থাপিত বালিকা বিদ্যালয়ে অর্থ সংস্থান রাখার নির্দেশ। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল বিদ্যাসাগরের উইলের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদটি। ওই অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত শ্রীযুক্ত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী এজন্য, ও অন্য অন্য গুরুতর কারণবশতঃ আমি তাহার সংশ্রব ও সম্পর্ক পরিত্যাগ করিয়াছি। এই হেতু বশতঃ বৃত্তিনির্বন্ধস্থলে তাঁহার নাম পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং এই হেতুবশতঃ তিনি চতুর্বিংশধারা নির্দিষ্ট ঋণ পরিশোধকালে বিদ্যমান থাকিলেও আমার উত্তরাধিকারী বলিয়া পরিগণিত অথবা… এই বিনিয়োগ পত্রের কার্যদর্শী নিযুক্ত হইতে পারিবেন না”।
উল্লেখ্য, পাঁচ পুত্রকন্যার মধ্যে নারায়ণ ছিলেন জ্যেষ্ঠ এবং একমাত্র পুত্র। কিন্তু তাঁকেই ত্যাজ্যপুত্র করতে দ্বিধা করেননি বিদ্যাসাগর। মনে রাখা দরকার, এই উইল লেখার পরও ১৬ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি, তবুও এই উইল পরিবর্তন করেননি। অথচ এই উইল লেখার কয়্কবছর আগে ১৮৭০ সালে বিদ্যাসাগর তাঁর একমাত্র পুত্র নারায়ণের সঙ্গে এক বিধবা ভবসুন্দরীর বিবাহ দিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র নিজেই একসময় জানিয়েছিলেন, তাঁর দীর্ঘ জীবনে দুটি ঘটনায় খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। সেগুলি হল মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনের প্রতিষ্ঠা এবং তাঁর পুত্র নারায়ণের বিবাহ দেওয়া। উল্লেখ্য, বিধবা ভবসুন্দরীর সঙ্গে নারায়ণের বিয়ে দেওয়া কোনও মতেই মেনে নিতে পারেননি বিদ্যাসাগরের বাবা-মা, স্ত্রী। ফলে তিনি একাই ফিরে আসেন কলকাতায়। এই ঘটনার পর তিনি কোনও দিন গ্রামের বাড়িতে পা রাথেননি। এমনকি তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর এবং শ্রাদ্ধেও তিনি গ্রামের বাড়ি যাননি।
শেষ জীবনে বিদ্যাসাগর দেনায় ডুবে ছিলেন। তাঁর একটি প্রেস ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কাজ এবং সমাজ সংস্কারের জন্য তিনি ওই প্রেসের দেখাশোনা করতে পারতেন না। ফলে কর্মীরা চরম বিশৃঙ্খলা শুরু করেন। একসময় ঋণে জর্জরিত বিদ্যাসাগর ওই প্রেসের দুই-তৃতীয়াংশ মাত্র ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন। ১৮৬৬ সালের ডিসেম্বর মাসে হুগলির উত্তরপাড়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শন করে ফেরার পথে তাঁর ঘোড়ার গাড়ি বালির কাছে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। অন্য একটি গাড়িতে ছিলেন মিস মেরি কার্পেন্টার নামের এক বিদেশীনী, স্কুল ইনস্পেক্টর উড্রো সাহেব এবং ডিপিআই অ্যাটকিনসন। তাঁর পেটে চোট লাগে। জানা যায় ওই দুর্ঘটনার পর থেকেই স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু করে বিদ্যাসাগরের। দীর্ঘ চিকিৎসায় ব্যাথা কমলেও পুরোপুরি সুস্থ হননি বিদ্যাসাগর। ১৮৯১ সালে যখন তাঁর মৃত্যু হয় তখন ডেথ সার্টিফিকেটে কারণ হিসেবে লেখা হয়েছিল লিভার ক্যানসার।
কি আশ্চর্য সমাপতন! সেই ২০০০ সালে রাজ্যে তখন ভরা বাম শাসন। রাজ্যের প্রধান বিরোধী নেত্রী তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময়...
Read more
Discussion about this post