তন্ত্র সাধনার সঙ্গে বিষ্ণব সাধনার অন্যতম ক্ষেত্র হিসাবে পরিচিত এই বাংলা। সতীপিঠের পাশাপাশি এই বাংলায় গড়ে ওঠেছে বৈষ্ণব সিদ্ধপীঠও। জানেন, শ্রীকৃষ্ণের জন্মভুমি বৃন্দাবনের মতো এরাজ্যেও রয়েছে ভগবানের কৃষ্ণের লীলাভুমিও। নাম রাখালরাজা মন্দির। লোক মুখে শোনা যায়, কৃষ্ণের এই মন্দিরে গেলেই নাকি দর্শন হয় বৃন্দাবন ধাম। কলকাতার খুব কাছেই রয়েছে ভগবান কৃষ্ণের এই মন্দির। কিন্তু কোথায় রয়েছে কৃষ্ণভূমি? পূর্ব বর্ধমানের কালনা ২ নং ব্লকের বৈদ্যপুর গ্রামে রয়েছে রাখাল রাজা মন্দির। অনেকেই হয়তো নাম শুনেছেন, কিন্তু জানেন না এই মন্দিরের মাহাত্ম্য। সুবিশাল বট গাছের তলায় রয়েছে কৃষ্ণের এই মন্দিরটি।
কথিত আছে, এই মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল ষোড়শ শতকে। কাটোয়ার খট্টোগ্রামের বাসিন্দা রামকানু গোস্বামী ছিলেন গোপীনাথের পরম ভক্ত। সেখানে তিনি এক শুদ্র ব্যক্তিকে দীক্ষা দেওয়ার অপরাধে স্ত্রীকে নিয়ে গ্রাম ত্যাগ করেছিলেন। এরপর তিনি বর্তমানে গোপালদাসপুরে এসে হাজির হন। সেখানে দেওয়ান জী নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় হয় রামকানুর। তখন দেওয়ান জী রামকানুকে কিছু জমি দান করেন। সেখানে তিনি মাধুকরি করে সংসার চালাতো। কালক্রমে রামকানুর তিন সন্তান হয়। তাদের নাম রাখেন নিমাই চাঁদ, বলদেব ও ছোট ছেলে রাখাল। একদিন রামাকানু পুজো করার জন্য ফুল তুলতে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন মাধবীফুল গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, অন্য কোনও গাছে একটিও ফুল ফোটেনি। ফুল না পেয়ে প্রচন্ড রেগে যান তিনি। মাধবী ফুল গাছ নষ্টের কথা ছেলেদের কাছে জানতে চাইলে কোনও সদোত্তর পান নি তিনি। তাতেই বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন রামকানু। ক্ষোভে রামকানু অভিশাপ দেন যে তার ফুলগাছ নষ্ট করেছে তার তিনদিনের মধ্যে মৃত্যু হবে। পরদিনই রাখাল অসুস্থ হয়ে পড়ে,রামকানু নজের ভুল বুঝতে পেরে গোপীনাথের শ্মরণাপন্ন হলেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
তিনদিনের মধ্যেই রাখালের মৃত্যু হয়। পুত্র শোকে রামকানুবাবু বৃন্দাবন যাত্রা করেন। যাত্রার মাঝে ক্লান্ত হয়ে মাঝ পথে কেলিকদম গাছের নিচে বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন রামকানু। সেই সময়ে স্বপ্নাদেশে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে জানিয়েছিলেন, তিনি যেন বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে না গিয়ে গৃহে ফিরে যায়। জঙ্গলের ভিতর এক পুষ্করীনির মধ্যে একটি নিমকাঠ ভাসছে সেটি তুলে নিয়ে আমার বিগ্রহ নির্মাণ করো। ওখানেই আমার মন্দির প্রতিষ্ঠা করো। আর এই মন্দিরে আমি রাখাল রাজা নামেই পুজিত হবো। তারপর থেকেই আজও এই মন্দিরে চলে নিত্য পুজো। রাখাল রাজার সঙ্গে এই মন্দিরে রয়েছে গোপীনাথের বিগ্রহও। যা গোস্বামীদের পারিবারিক বিগ্রহ বলে মনে করা হয়।
তবে জানেন, বৃন্দাবনের নিধিবনের মতো এখানেও সূর্যাস্তের পর এই মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ। লোক মুখে শোনা যায়, নিধিবনে যেমন রাত গভীর হলেই রাসলীলা মাতেন কৃষ্ণ। ঠিক তেমনই সূর্যাস্তের পর এখানে ধেনুদের নিয়ে চড়ান রাখাল রাজা। তাই অন্ধকার নামলেই কোনও এক লৌকিক শক্তি যেন মন্দির প্রাঙ্গন খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তাই মানুষ কেন সূর্য ডুবলেই মন্দির প্রাঙ্গণে থাকতে পারে না কেউই। শুধু জন্মাষ্টমী নয়, দোল পূর্ণিমা থেকে শুরু করে মাঘী পূর্ণিমা বেশ ধুমধাম করেই পুজো হয় এই মন্দিরে। যদি আপনি বৃন্দাবন ধামে যেতে না পারেন, তাহলে আজই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আসুন এই রাখাল রাজা মন্দিরে।
Discussion about this post