হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগরের উপকূল, এই মধ্যবর্তী এলাকার মধ্যে ভূভাগের আবহাওয়ার পূর্বাভাস করা খুবই কঠিন। কারণ এই বিস্তৃর্ণ অঞ্চল মূলত পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে জুড়ে থাকে বাটারফ্লাই এফেক্টস। পদার্থবিজ্ঞান এবং পরিসংখ্যান মিলিয়ে বাটারফ্লাই এফেক্টস গড়ে উঠেছে। ফলে সেটি যে খুব সহজ কোনও তত্ত্ব হবে না, সেটা বলাই বাহুল্য। তার চেয়ে বরং ঘূর্ণিঝড় কেন সৃষ্টি হয়, কিভাবে সৃষ্টি হয়, তার বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধান করা যেতে পারে। বর্তমানে বাংলার বুকে আশঙ্কা তৈরি করছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। বিগত কয়েকদিন যারা আবহাওয়ার খবরের দিকে নজর রাখছেন, তাঁরা অবশ্যই জানতে পেরেছেন, বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া একটি নিম্নচাপ ডেকে আনছে ঘূর্ণিঝড় রেমালকে। তার মানে নিম্নচাপের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে ঘূর্ণিঝড়ের। তাহলে এবার জেনে নেওয়া যাক নিম্নচাপ আসলে কী?
আমরা আসলে বাতাসের সমুদ্রে বসবাস করি। এই বাতাসের একটা চাপ থাকে। তবে বাতাস দেখা যায় না বলেই আমরা বাতাসের চাপ সেভাবে বুঝতে পারি না। এই বাতাসের চাপ কিন্তু সময়ে সময়ে কম বা বেশি হয়। বিশেষ করে কোনও জায়গায় বেশি আবার কোনও জায়গায় কম। আর এই কম-বেশির ফারাকটা যখন অনেক বেশি হয়ে যায় তখনই আসে বিপদ। আশেপাশের এলাকার চেয়ে যখন কোনও জায়গায় বায়ুর চাপ কমে যায়, তাহলে সেখানে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। এই নিম্নচাপের অন্যতম একটা কারণ হল বায়ুর ঘনত্ব। যে অংশের ঘনত্ব যত বেশি, তার তাপধারণ ক্ষমতা ততই বেশি। মাটি, জলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাপধারণ ক্ষমতা বেশি মাটির। অর্থাৎ ভূভাগে বায়ুর ঘনত্ব বেশি। দিনের বেলা উষ্ণ মাটি বা ভূপৃষ্টের লাগোয়া বাতাসের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। অন্যদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের লাগোয়া বায়ুর তাপমাত্রা ততটা বাড়ে না। এখানেই ভূপৃষ্ঠ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের বায়ুর উষ্ণতার পার্থক্য তৈরি হয়।
বিজ্ঞান বলছে, তাপমাত্রা যত বাড়ে ততই বস্তুগুলোর ভিতর থাকা অনুর দূরত্ব বাড়তে থাকে। ফলে সে বস্তুর ঘনত্ব ততই কমতে থাকে। ভূপৃষ্ঠ লাগোয়া বায়ু অধিক উত্তপ্ত হয়ে পড়ায় কমতে থাকে বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব। ফলে বাতাস এই অঞ্চলে হালকা হতে শুরু করে। আর বাতাস হালকা হলেই উপর দিকে উঠে যায়। আর সেই শূন্যস্থান দখল করতে শুরু করে বেশি ঘনত্বের শীতল বাতাস। অপরদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা অধিক তারতম্য না ঘটায় সেখানকার বায়ুর চাপ বেশিই থাকে।ফলে বায়ুর চাপের ভারসাম্য হারিয়ে যায়। তখনই সমুদ্রপৃষ্ঠের শীতল বাতাস ধেয়ে আসতে শুরু করে ভূপৃষ্ঠের উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে। ফলে তৈরি হয় ঝোড়ো হাওয়া। একেই বলে নিম্নচাপ।
এবার এই প্রক্রিয়া যদি অত্যন্ত দ্রুতার সঙ্গে ঘটতে থাকে, তখনই শূন্যস্থান পূরণ করতে অত্যধিক হুড়োহুড়ি করে শীতল বাতাস ছুটে আসতে থাকে। তখনই সৃষ্টি হয় বাতাসের ঘূর্ণন। নিম্নচাপের জায়গায় বায়ুর চাপ যত কম, ততই ছুঁটে আসা বাতাসের বেগ বেড়ে যায়। ঘূর্ণনও তত বেড়ে যায়। এভাবেই তৈরি হয় ঘূর্ণিঝড়। আর সেই কারণেই সমুদ্রপৃষ্ঠে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে শক্তিশালী হয়। আর একটি বিষয় মাথায় রাখা হয়, নিম্নচাপ থেকে সৃষ্ট কোনও ঘুর্ণিঝড় সমুদ্রপৃষ্ঠে যতদিন অবস্থান করবে, তার শক্তি ততই বেশি হবে। কারণ, সে বাতাস থেকে যত জলীয় বাস্প সংগ্রহ করবে, ততই তাঁর শক্তি বাড়বে। প্রতি বছরই এপ্রিল এবং মে মাসে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলে সৃষ্টি হয় নিম্নচাপ। আর সেই নিম্নচাপের মধ্যে কোনও একটি ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়। এখন দেখার এই ঘূর্ণিঝড় রেমাল কতটা শক্তি সঞ্চয় করে বঙ্গ উপকূলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
Discussion about this post