পঞ্চ সতীপীঠের জেলা হল বীরভূম, অর্থাৎ বীরের ভূমি। পুরাণে বর্ণিত ৫১টি সতীপীঠের মধ্যে পাঁচটিই রয়েছে লালমাটির দেশ বীরভূমে। ৫১টি সতীপীঠের শেষ পীঠ কঙ্কালিতলা, যেখানে সতী মায়ে কোমরের অংশ পতিত হয়েছিল। যদিও কঙ্কালিতলায় মায়ের কোনও বিগ্রহ নেই। নলহাটি শহরের নলাটেশ্বরী আরেক সতীপীঠ। এখানে সতী মায়ের কণ্ঠনালী পতিত হয়েছিল। বীরভূমের সাঁইথিয়া শহরে নন্দীকেশ্বরী মন্দির। এটি উপপীঠ হিসেবে গণ্য করা হয়। বীরভূমের লাভপুরে অবস্থিতি ফুল্লরা সতীপীঠ রয়েছে। এবং সবশেষে উল্লেখ করা যায় বক্রেশ্বর। যেখানে সতীমায়ের দুই ভ্রু-যুগলের মধ্যের অংশ অর্থাৎ মন পতিত হয়েছিল। ফলে সদা জাগ্রত এই মন্দিরের ইতিহাসও অত্যন্ত প্রাচীন। তবে আজ আমরা বক্রেশ্বরের আরেক আশ্চর্য উষ্ণ প্রসবণ নিয়ে আলোচনা করব। বক্রেশ্বরের উষ্ণ প্রসবণগুলিতে সারা বছরই জল গরম থাকে। প্রকৃতির এই অপরূপ লীলার কাহিনী জেনে নেওয়া যাক এই প্রতিবদনের মাধ্যমে।
শুধু তীর্থের টানে নয়, বীরভূমের বক্রেশ্বরে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসেন এই উষ্ণ প্রসবণের জন্য। ভক্তদের বিশ্বাস, একসঙ্গে একাধিক তীর্থের পূণ্য লাভ হয় বক্রেশ্বরে এসে। কারণ এখানে সতীপীঠ ছাড়াও রয়েছে বক্রেশ্বর শিবের মন্দির। পাশাপাশি রয়েছে প্রাকৃতিক উষ্ণ প্রসবণ। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, এই প্রসবণের জল সর্বদা গরম থাকে। কিন্তু কেন এখানকার জল এত গরম থাকে, কোথা থেকেই বা আসছে এই গরম জল, এই প্রশ্নগুলিও আসে সাধারণ মানুষের মনে।
বক্রেশ্বরে মোট দশটি কুণ্ড বা পুকুর আছে, যেখানে সর্বদা গরম জল পাওয়া যায়। এই কুণ্ডগুলির নাম হল, পাপহরা গঙ্গা, বৈতরণী গঙ্গা, খরকুণ্ড, ভারবকুণ্ড, অগ্নিকুণ্ড, দুধকুণ্ড, সূর্যকুণ্ড, শ্বেতগঙ্গা, ব্রক্ষ্ণাকুণ্ড এবং অমৃতকুণ্ড। আর সবচেয়ে আশ্চর্ষের বিষয় হল, এই প্রতিটি কুণ্ডের জলের তাপমাত্রা আলাদা আলাদা। জানা যায়, খর, ভৈরব ও সূর্যকুণ্ডের জলের তাপমাত্রা যথাক্রমে ৬৬, ৬৫ ও ৬১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দুধকুণ্ডের জলের তাপমাত্রা ৬৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দুধকুণ্ডের জল অতি ঘণ হওয়ার জন্য ভোরের দিকে এই প্রসবণের জল সাদা ও নিস্তেজ দেখায়। অগ্নিকুণ্ডের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অগ্নি মানে আগুন, তাই এর জল সবচেয়ে বেশি গরম। তবে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় জানা গিয়েছে, এখানকার উষ্ণ প্রসবণগুলিতে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, সিলিকেট, ক্লোরাইড, বাইকার্বোনেট এবং সালফেটের মত অনেক খনিজ সমৃদ্ধ, যার ঔষধি গুণ রয়েছে বলে জানা যায়। এটিতে তেজস্ক্রিয় উপাদানও উপস্থিত থাকতে পারে। অগ্নিকুণ্ডটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এর থেকে সর্বদা হিলিয়াম গ্যাস নির্গত হচ্ছে। চারদিক ডিম সেদ্ধর মতো গন্ধে ম ম করে। ভারত সরকারের আণবিক পরীক্ষা বিভাগ এখানকার কুণ্ডগুলি থেকে হিলিয়াম গ্যাস সংগ্রহ করছে। বর্তমানে উষ্ণ প্রসবণেপ কুণ্ডগুলি সুন্দরভাবে রক্ষিত আছে। কাউকে জলের কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয় না। ওপর থেকে দড়িতে ঘটি বা বালতি ঝুলিয়ে জল তুলে নিয়ে বোতলে ভরে ‘তীর্থসলিল’ নামে বিক্রি হয়। বহু রোগ, বাত-ব্যাধি, হাঁপানি এমনকি অম্বলও নাকি ভাল হয়ে যায় এই জল পান করলে। এছাড়া, কুণ্ড বা পুকুরগুলির ঘাট বাঁধানো, মকরমুখ থেকে সর্বদা গরমজল ঝরে পড়ছে। মহিলা ও পুরুষদের আলাদাভাবে স্নানের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে তেল ও সাবান মাখা নিষিদ্ধ। কুণ্ডসমূহের জল পাপহরা নদীতে পড়ে বক্রেশ্বর নদের সঙ্গে মিশে গিয়েছে।
এ তো গেল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। তবে বক্রেশ্বরের পৌরাণিক দিকও অতি সমৃদ্ধ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, সত্যযুগে লক্ষ্মী ও নারায়ণের বিবাহ অনুষ্ঠানে সুব্রত মুনি দেবরাজ ইন্দ্র কর্তৃক অপমানিত হন। ক্রুদ্ধ ঋষির দেহ আটটি বাঁকে বেঁকে যায়। ফলে তিনি অষ্টবক্র ঋষি নামে পরিচিত হন। অষ্টবক্র ঋষি বহুবছর শিবের তপস্যা করেন এবং এখানকার উষ্ণ প্রসবণে স্নান করে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাই এখানকার উষ্ণ প্রসবণগুলি একদিকে যেমন অতি পবিত্র অন্যদিকে রোগ নিরাময়ের ক্ষমতাও অপরিসীম।
Discussion about this post