২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের কয়েকদিন আগে দল বদল করে বিজেপিতে গিয়েছিলেন অর্জুন সিং। এরপর তৃণমূলের তৃণমূলেরই দীনেশ ত্রিবেদীকে হারিয়ে সাংসদ হন তিনি। লোকসভার টিকিট পাওয়া নিয়েই ছিল তাঁর দলত্যাগ। কিন্তু খাতায়কলমে বিজেপি সাংসদ থেকেও ২০২১ বিধানসভা ভোটের পর তৃণমূলে ফিরে আসেন ব্যারাকপুরের ‘সিংহ’। এবারের লোকসভা ভোটের আগে সেই একই নাটক মঞ্চস্থ হল, তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে অর্জুন ফের বিজেপিতে। কিন্তু গতবারের তাঁর প্রতিপক্ষ দীনেশ ত্রিবেদী ঘটনাচক্রে এখন বিজেপিতে। ব্যারাকপুরে তৃণমূল দিয়েছে নতুন প্রার্থী, নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিক। ফলে ব্যারাকপুরে এখন অর্জুনের মুখোমুখি পার্থ। সোজা কথায় ব্যারাকপুরে এখন ঠিক যেন মহাভারতের উলোটপুরাণ। মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুনের সারথি ছিলেন পার্থ তথা কৃষ্ণ। এখানে দুজন সম্মুখসমরে।
অর্জুন সিং তৃণমূলের টিকিটে ভাটপাড়া বিধানসভায় প্রথম জিতেছিলেন সেই ২০০১ সালে। তখন রাজ্যে বাম জমানা। তবুও ভাটপাড়ায় তাঁর প্রবল প্রতিপক্ষ সিপিএমের রাম প্রসাদ কুণ্ডুকে হারিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। যদিও ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়ে অর্জুন হেরে যান তড়িৎ বরণ তোপদারের কাছে। অর্জুন আজও বলেন, ব্যারাকপুরের সেই ডাক সাইটে নেতার সঙ্গে তাঁর মামা-ভাগ্নের সম্পর্ক। বাম জমানা গিয়েছে, তৃণমূল বাংলা শাসন করছে প্রায় ১৩ বছর। তবু এবারও অর্জুন বিজেপির টিকিট পাওয়ার পরই ছুটে গিয়েছেন ‘মামা’ তড়িৎ বরণ তোপদারের আশীর্বাদ নিতে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, বারবার দল বদল করা অর্জুন কী এবার লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন? ব্যারাকপুরবাসীর মনে তিনি কতটা দাগ কাটতে পারবেন? মহাভারত যুদ্ধের বিপরীতে গিয়ে তিনি পার্থকে হারাতে পারবেন?
গঙ্গাতীরের এক প্রাচিন জনপদ ব্যারাকপুর। এখানকার অর্থনীতি চটকলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকায় ব্যারাকপুরকে শিল্পাঞ্চলের তকমা দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে এখানে শিল্পের হার হাতেগোনা। বন্ধ অধিকাংশ চটকল। একটা সময় ছিল ব্যারাকপুরে শক্ত ঘাঁটি গড়েছিল বামফ্রন্ট। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ব্যারাকপুরে সাতবার জিতেছিলেন ডাক সাইটে সিপিএম নেতা তড়িৎ বরণ তোপদার। ২০০৯ সালের লোকসভাতেই পালা বদল হয় ব্যারাকপুরে। এরপর গোটা বাংলায় পালা বদল হয়েছিল গোটা বাংলায়। ২০০৯ সালে তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হন দীনেশ ত্রিবেদী, তখন তাঁর সারথী ছিলেন এই অর্জুন সিং। এরপর ২০১৪ সালেও জেতেন তৃণমূলের দীনেশ। কিন্তু অর্জুন সিং বাঁধ সাধেন ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে। তিনি ব্যারাকপুরের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দল টিকিট দেয়নি। ফলে ভোটের মাত্র কয়েকদিন আগেই তৃণমূল ত্যাগ করে অর্জুন পদ্ম শিবিরে পা গলান। বিজেপির টিকিটে ভোটে লড়ে তৃণমূলের দীনেশ ত্রিবেদীকে হারিয়ে চমক দেন। জয়ের ব্যবধান ছিল মাত্র ১৪ হাজার ৮৫৭ ভোটের। এর পর ব্যারাকপুরের গঙ্গাতীরে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। ২০২১ বিধানসভার পর ঘরের ছেলে হয়ে ঘরে ফিরেছিলেন অর্জুন, পদ্ম ছেড়ে ঘাসফুলে সাওয়ার হন তিনি।
অর্জুনের দাবি, তাঁকে এবার লোকসভার টিকিট দেওয়া হবে বলেই তৃণমূলে ফেরানো হয়েছিল। কিন্তু ব্রিগেডের জনগর্জন সভার মঞ্চে নাম ঘোষণা হল পার্থ ভৌমিকের। তৎক্ষনাৎ ব্রিগেডের মঞ্চ ত্যাগ করেন অর্জুন। এরপর কয়েকদিনের নাটক, ফের ঘাসফুলের সঙ্গ ত্যাগ করে পদ্মে যোগ দিলেন। এবারও গতবারের পুনরাবৃত্তি করে বিজেপির টিকিটে ব্যারাকপুরের যুদ্ধে সামিল। তৃণমূলের প্রচারে বারবার এটাই উঠে আসছে, বিজেপিতে ‘দলবদলু’ অর্জুনের ভূমিকা কী? অর্জুন সিং ফের বিজেপি আসা, লোকসভার টিকিট পেয়ে ভোটে দাঁড়ানো একেবারেই মেনে নিতে পারেননি স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব। প্রকাশ্যেই কয়েকদিন বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল ব্যারাকপুরে। কিন্তু দীর্ঘদিনের পোড়খাওয়া রাজনৈতিক অর্জুন ধীরে ধীরে সেই বিদ্রোহে মলম লাগাতে সক্ষম হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে ব্যারাকপুরের জগদ্দলে জিলিপি মাঠে প্রচারে আসেন অর্জুনের সমর্থনে। তিনিও প্রকাশ্য জনসভায় অর্জুনের ভূয়সী প্রশংসা করে তাঁকে জেতানোর ডাক দিলেন। ফলে বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে নতুন করে উদ্দিপনা দেখা দিল। এরপরই প্রকাশ্যে আসে অর্জুন সিংকে প্রধানমন্ত্রীর লেখা বাংলায় চিঠিটি। তাতেও তিনি ব্যারাকপুরবাসীকে আহ্বান জানান অর্জুন সিংকে জেতানোর। যা ভোট-যুদ্ধে অর্জুনকে কয়েক কদম এগিয়ে দেবে এ কথা বলাই যায়।
ব্যারাকপুরে কান পাতলেই শোনা যায়, অর্জুন সিং নিজের এলাকা হাতের তালুর মতো চেনেন। তৃণমূলের সংগঠন একসময় তাঁর হাতেই তৈরি, এই সমস্ত কথা। অপরদিকে এও শোনা যায়, বর্তমানে তৃণমূলের অন্দরে অর্জুনের বিরোধীগোষ্ঠীর প্রভাব। জগদ্দলের বিধায়ক সোমনাথ শ্যাম প্রকাশ্যেই অর্জুন বিরোধীতা করেন। নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিক এবার নিজেই লোকসভার প্রার্থী অর্জুনের বিরুদ্ধে। নোয়াপাড়ার বিধায়ক মঞ্জু বসুর সঙ্গে অর্জুনের সম্পর্ক সর্বজনবিদিত। কাঁচড়াপাড়ার সুবোধ অধিকারী এবং ব্যারাকপুরের বিধায়ক রাজ চক্রবর্তীর অবস্থানও স্পষ্ট। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র ভাটপাড়া বিধানসভাই রয়েছে বিজেপির দখলে। কানাঘুঁসো শোনা যাচ্ছে, আমডাঙার বিধায়ক অর্জুনের পাশে রয়েছেন। আরেকটি ফ্যাক্টরও মাথায় রাখতে হবে। সেটা হল ২০১৯-এর ভোটে অর্জুনকে জেতাতে সাহায্য করেছিলেন মুকুল রায় এবং মণীশ শুক্ল। এবার দুজনেই নেই। মণীশ খুন হয়েছেন আর মুকুল রায় সন্যাস গ্রহন করেছেন। তাহলে অর্জুনের জয়ের আশা কী একেবারেই নেই?
অর্জুনের ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, এখানেই রয়েছে টুইস্ট। অন্দরের খবর, অর্জুনের হাতিয়ার তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল এবং বন্ধ চটকলের শ্রমিকরা। বিগত কয়েক বছরে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে একের পর এক জুটমিল বন্ধ হয়েছে। জগদ্দলের মেঘনা জুটমিলের দখল অর্জুনের হাতে অন্যদিকে অ্যালায়েন্স জুটমিল সোমনাথ শ্যামের হাতে। শ্রমিকদের আধিপত্য যার দিকে ব্যারাকপুরে জয়ের মালা তাঁর দিকেই থাকে, এটা বরাবরের নিয়ম। লোকসভা ভোটের প্রচারে অর্জুন বন্ধ জুটমিলের সমস্যা, কেন্দ্রের জুটনীতি এবং বিপুল বরাত নিয়ে অনবরত প্রচার করে যাচ্ছেন। তৃণমূলের উন্নয়নের চিত্র ফিকে করতে অর্জুন এবার সর্বদা উদ্যোগী। রাজনৈতিক মহলের একাংশ দাবি করছেন, ব্যারাকপুরে ধর্মীয় বিভাজনও খুব স্পষ্ট। এখানে নৈহাটির বড় মা, রামপ্রসাদের ভিটে যেমন আছে, তেমনই বজরংবলী এবং রামভক্তও আছেন। ব্যারাকপুরে বাঙালি হিন্দু এবং অবাঙালি হিন্দুর সংখ্যার পার্থক্যও উনিশ-বিশ। একটা বড় অংশ রয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তৃণমূলের পার্থ ভৌমিকের ইউএসপি তাঁর স্বচ্ছ ভাবমূর্তি। সম্প্রতি আবার প্রলয় ওয়েব সিরিজে পার্থ ভৌমিকের অভিনয় যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছে দর্শকমহলে। নৈহাটিকে তিনি সাজিয়েছেন মনের মতো করে। তৃণমূলের প্রচারে এটাই উঠে আসছে বারবার। তবে একটা বিষয় এবার সকলের নজর কাড়ছে। সেটা হল ২০১৯-এর মতো এবার নেই নিত্যনৈমত্তিক বোমা-গুলির ঘটনা। এবার আপত শান্ত ব্যারাকপুর দেখে অনেকেই আলোচনা করছেন, এবার কী ব্যারাকপুরে ‘আবার প্রলয়’?
Discussion about this post