প্রতি বছরই নিয়ম করে বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করে মার্কিন পত্রিকা ফোবর্স। সেই তালিকা তাঁরা প্রতিনিয়ত আপডেটও করে খাকে। ফলে অনেকেরই নজর থাকে সেই তালিকার দিকে। বিশেষ করে প্রথম ১০০ জন ধনীতম ব্যক্তির মধ্যে ভারতের কত জন আছেন, কে কে আছেন সেই তালিকায়, এগুলি নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। কিন্তু প্রতিবার খুঁজেও সেই তালিকায় নাম পাওয়া যায় না টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান রতন টাটার নাম। জানিয়ে রাখি, বিশ্বের ৬টি মহাদেশের ১০০টির বেশি দেশে ৩০টির বেশি লিস্টেড কোম্পানি পরিচালনা করে ভারতের ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান টাটা গ্রুপ। ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত টাটা গ্রুপের সামগ্রিক মূলধন কিন্তু ৩৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। রতন টাটা আমৃত্যু সেই টাটা গ্রুপের এমিরিটাস চেয়ারম্যান। ফলে তাঁর সম্পদের পরিমান নেহাত কম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু রতন টাটার নাম ফোবর্সের তালিকা তো দূর, ভারতের প্রথম দশ ধনীর তালিকাতেই নেই। কেন নেই, সেই উত্তর খুঁজতে গিয়ে উঠে আসছে চমকপ্রদ তথ্য।
৮৬ বছর বয়সে মারা যান রতন টাটা। একজন শিল্পপতি হলেও তিনি যে কতটা জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন সেটা আর কাউকে বুঝিয়ে দিতে হবে না। কারণ, অকৃতদার এই ব্যক্তি আজীবন একজন দায়িত্বশীল শিল্পপতি হিসেবে দেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি ব্যবসায়ীক লাভ-লোকসান যেমন সামলেছেন, তেমনই সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাও তিনি কখনও অস্বীকার করেননি। সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হল, রতন টাটা কখনই বিলিয়নিয়ারের তালিকায় ঠাঁই পাননি। আইআইএফএল ওয়েলথ হুরুণ ইন্ডিয়ার ধনী ব্যক্তির তালিকায় রতন টাটার সর্বশেষ স্থান ছিল ৪২১তম। সেই তালিকা অনুযায়ী রতন টাটার সর্বশেষ সম্পদের পরিমান ৩,৮০০ কোটি টাকা। যে সংস্থার বর্তমান মূলধন ৩৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি, সেই সংস্থার কর্ণধারের সম্পদ মাত্র ৩,৮০০ কোটি টাকা।
ফোবর্স তালিকার বিশ্বের প্রথম একশো ধনী ব্যক্তির তালিকায় ১৪ নম্বরে নাম রয়েছে মুকেশ আম্বানির। তাঁর মোট সম্পদের পরিমান বর্তমানে ১০৬.২ বিলিয়ন ডলার। ২১তম স্থানে রয়েছেন ভারতীয় শিল্পপতি গৌতম আদানি। তাঁর মোট সম্পদের পরিমান ৮০.৩ বিলিয়ন ডলার। এরপর যাদের নাম আসে তাঁরা হলেন, এইচসিএলের কর্ণধার শিব নাদার রয়েছেন ৪১তম স্থানে। জিন্দাল গ্রুপের কর্ণধার সাবিত্রী জিন্দালের নাম রয়েছে ৪২তম স্থানে। সান ফার্মার কর্ণধার দিলীপ সাংভির নাম রয়েছে ৬১তম স্থানে। সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা সাইরাস পুনাওয়ালা রয়েছেন ৮১তম স্থানে এবং বিড়লা গ্রুপের চেয়ারম্যান কুমার বিড়লার নাম রয়েছে ৮২তম স্থানে। সেখানে দূর দূরান্ত পর্যন্ত নাম নেই রতন টাটার। আর ঠিক এই কারণেই রতন টাটাকে দেশবাসী এত ভালোবাসেন। কারণ, তিনি নিজে ধনী হতে চাননি কোনওদিন। বরং দেশের দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য নিজের সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে গিয়েছেন। আগামীদিনেও যাতে এই মহান কাজ অব্যহত থাকে সেই জন্য তৈরি করে গিয়েছেন দেশের বৃহত্তম দাতব্য ফাউন্ডেশন টাটা ট্রাস্ট।
জানা যায়, রতন টাটা তাঁর সম্পদের ৬৬ শতাংশ সরাসরি টাটা ট্রাস্টে জমা করতেন। এমনকি তাঁর অধীনে থাকা সংস্থাগুলির মুনাফার বেশিরভাগটাই যায় টাটা ট্রাস্টে। এই দাতব্য সংস্থার কাজই হল দেশের পিছিয়ে পড়া সমাজের উন্নতি সাধন করা। শিক্ষা থেকে চিকিৎসা সেবা ক্ষেত্র, কর্ম সংস্থান সৃষ্টি থেকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের উন্নতি, টাটা ট্রাস্ট উল্লেখযোগ্য কাজ করে চলেছে। টাটা সন্সের ইক্যুইটির ৬৬ শতাংশ টাটা ট্রাস্টের হাতে রয়েছে। যা মূলত জনহিতকর কাজেই ব্যবহৃত হয়। তাই রতন টাটা ব্যক্তিগতভাবে ধনী হতে পারেননি কোনও দিনও। টাটা ট্রাস্টের অধীনে মহারাষ্ট্র, অসম, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটকে ১০টির বেশি ক্যান্সার হাসপাতাল এবং রিসার্চ সেন্টার রয়েছে। সবমিলিয়ে ৮৬ বছরের এই কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব বিলিয়নিয়ার নয়, বরং সামাজিক দায়বদ্ধতার নিরীখে একজন সম্মানীয় ব্যক্তি হিসেবে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।
Discussion about this post