মা কালীকে আমরা অতি ভয়ঙ্করী রূপেই দেখতে অভ্যস্ত। তবে এর ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। যেমন উত্তর ২৪ পরগণার আমডাঙায় করুণাময়ী কালী মন্দিরে। মায়ের রূপ এখানে অতি শান্ত এবং সৌম। প্রায় সাড়ে তারশো বছরের পুরোনো এই কালীমূর্তি দেখলে মন ভরে যাবে আপনার। মা এখানে মঙ্গলকারী করুণাময়ী। তাই আজও মনোস্কামনা পূরণের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন অসংখ্য ভক্ত আসেন আমডাঙা করুণাময়ী কালীমন্দিরে। আর কালী পুজোর দিনগুলিতে ভক্তদের বাঁধ ভাঙে আমডাঙায়। আজ আমরা জানাবো আমডাঙা কালীমন্দিরের সমৃদ্ধ ইতিহাস সম্পর্কে।
ইতিহাস বলে, মূঘল সম্রাট আকবর দিল্লির মসনদে বসেই নজর দেন সুজলা-সুফলা শস্যশ্যমলা বাংলার দিকে। সেই সময় বাংলা শাসন করতেন বারো ভুঁইয়া বা বারো জন রাজা। এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলেন যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্য। এই বারোজন ভুঁইয়া বা রাজাকে দমন করতে মুঘল সম্রাট আকবর বিশাল সৈনবাহিনী-সহ পাঠালেন যুবরাজ সেলিমকে। কিন্তু তিনি যশোরের রাজার কাছে পরাজিত হয়ে দিল্লি ফিরলেন। এরপর আকবর বাংলায় পাঠালেন তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি তথা মহারাজা মান সিংহকে। কিন্তু মান সিংহের নেতৃত্বে শক্তিশালী মুঘল সেনা দু’বার পরাজিত হয় যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের কাছে। আশ্চর্যচকিত হয়ে যান মুঘল সম্রাট। মান সিংহ হারের কারণ বিশ্লেষণ করতে আকবরকে জানান, বাংলার এক দেবীর অলৌকিক কাহিনী এবং জনশ্রুতি সম্পর্কে। তিনি জানান, যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের শক্তির মূল আধার হলেন মা কালী। যিনি যশোরেশ্বরী কালী মন্দির হিসেবে বিখ্যাত। মান সিংহ জানতে পারেন, এই যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরে পুজো দিয়েই প্রতাপাদিত্য প্রতিবার যুদ্ধে যান, এবং জয়লাভ করেন।
এরপরই এক ভয়ানক চাল চালেন মহারাজা মান সিংহ। তিনি কৌশলে যশোরেশ্বরী কালী মায়ের বিগ্রহ সরিয়ে ফেলেন। এ কথা জানতে পেরে প্রতাপাদিত্য ওই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রামানন্দ গিরিকে শাস্তি দেন এবং নির্বাসিত করেন। তিনি যশোর থেকে চলে আসেন অধুনা আমডাঙার কাছে শুখাবতী নদীর তীরে একটি স্থানে। রাগে, অপমানে ওই সাধক রীতিমতো উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন বলেই জনশ্রুতি। অন্যদিকে মহারাজা মান সিংহ এবার সত্যিই যুদ্ধে প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করেন এবং বাংলার দখল নেন। ওদিকে মহারাজা মান সিংহ যশোরেশ্বরী মায়ের মূর্তি নিয়ে রাজস্থানের অম্বরে। সেখানেই তিনি নতুন করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মা যশোরেশ্বরী সূর্তি স্থাপন করেন। কথিত আছে, এরপরই মান সিংহ স্বপ্নাদেশ পান মা কালীর। তিনি জানতে পারেন, মায়ের শিষ্য সাধক রামানন্দ গিরি শুখাবতী নদীর তীরে উন্মাদ অবস্থায় রয়েছেন। দেবী মান সিংহকে আদেশ করেন, তাঁর শিষ্যকে পুনরায় সাধনমার্গে ফিরিয়ে আনতে সেখানেই কষ্টিপাথরের একটি কালীমূর্তি স্থাপন করতে হবে। মান সিংহ মা কালীর ওই আদেশ পালন করতে আমডাঙায় আসেন এবং ১৫৬১ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান আমডাঙায় করুণাময়ী কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। মায়ের মূর্তি এখানে শান্ত এবং সৌম। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা যেমন ঐতিহাসিক, তেমনই পরবর্তীকালেও বহু ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে আমডাঙা কালী মন্দির ঘিরে।
কথিত আছে, মীরজাফরের পতনের পর মীরকাশেম বাংলার মসনদ দখল করেন। সেই সময় মীরকাশেমের সঙ্গে মতানৈক্য হয় কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের। মীরকাশেম তাঁর প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন। কৃষ্ণচন্দ্র পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন এই আমডাঙা কালী মন্দিরেই। তৎকালীন করুণাময়ী মঠের প্রধান মহোন্ত নারায়ণ গিরি এখানকার পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে মা করুণাময়ীর আরাধনা করেন। এরপরই আশ্চর্যজনকভাবে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র বিপদমুক্ত হন। সেই সময় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরের জীর্ণ দশা দেখে খুবই পীড়িত হয়েছিলেন। কৃতজ্ঞ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই কালীমন্দিরকে ৩৬৫ একর জমি দান করেন। এবং মন্দিরটি সংস্কার করিয়ে দেন। আমডাঙা করুণীময়ী কালী মায়ের কষ্টিপাথরের মূর্তিটি সাড়ে চারশো বছরেরও বেশি পুরোনো। বর্তমান মন্দিরের বেশিরভাগটাই নির্মান করিয়েছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। আর বর্তমানে যে ১৪টি শিবমন্দির রয়েছে মূল মন্দিরকে ঘিরে, সেগুলিও এথানকার মহোন্তদের সমাধিক্ষেত্র। বর্তমান মন্দিরে মান সিংহের স্মৃতি বলতে রয়েছে মূল মূর্তিটি এবং গর্ভগৃহে চন্দন কাঠের দরজার কাঠামোটি। দুটিই সাড়ে চারশো বছরের পুরোনো। আর একটি কথা, যশোরেশ্বরী কালী মায়ের মূল মূর্তিটি আজও রাজস্থানের অম্বরের রাজপ্রাসাদে প্রতিষ্ঠিত।
Discussion about this post