একদিন পরই গোটা দেশ পালন করবে ভারতের স্বাধীনতা দিবস। নানান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সকলে মেতে উঠবেন উৎসবে-আনন্দে। কিন্তু দিন দিন যে ভাবে মহিলাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। সরকারি মেডিকেল কলেজের ভিতরেই ধর্ষণ করে খুন করা হচ্ছে তরুণী চিকিৎসক পড়ুয়াকে, তাতে তো প্রশ্নচিহ্ন উঠবেই। এই সেই আগষ্ট মাস, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসেই কলকাতার প্রথমসারির বিশ্ববিদ্যালয় যাদবপুরে খুন হয়েছিলেন মেধাবী পড়ুয়া স্বপ্নদীপ কুণ্ডু। একবুক স্বপ্ন নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল স্বপ্নদীপ। কিন্তু প্রথমবছরেই তাঁর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ভারতের স্বাধীনতার মসেই হোস্টেশের ছাদ থেকে পড়ে মারা যায় ওই মেধাবী পড়ুয়া। আবার এই আগষ্ট মাসেই নৃশংশভাবে খুন হলেন কলকাতার প্রথমসারির মেডিকেল কলেজের তরুণী চিকিৎসক পড়ুয়া। মৃত্যুর আগে তাঁকে ধর্ষণও করা হয়েছে বলে প্রমান পাওয়া যাচ্ছে ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে। একদিকে যাদবপুর অন্যদিতে আর জি কর হাসপাতাল। দুই প্রান্তের দুই প্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া দুই নৃশংস ঘটনার মধ্যে সময়ের ব্যবঘান এক বছরের হলেও, ঘটনাপ্রবাহ একই।
যাদবপুরের ক্ষেত্রেও পুলিশ অতি সক্রিয়তা দেখিয়ে তুলে ধরেছিল আত্মহত্যার তত্ত্ব। আর জি করের ক্ষেত্রেও আমরা সেটাই দেখলাম। ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার করার পরও মৃতার পরিবারকে পুলিশ জানালো তাঁদের মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তড়িঘড়ি ময়নাতদন্তও হয়ে গেল এবং মৃতা তরুণী চিকিৎসকের বাড়িতেও দেহ পৌঁছে দিল পুলিশ। কিন্তু তাঁর অভাগা বাবা-মা জানতেও পারলেন না। এখানেই পুলিশের অতি সক্রিয়তার প্রশ্ন উঠছে। আবার এই নারকীয় ঘটনায় রাতারাতি একজনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর পরিচয় নিয়ে মুখে কুলুপ কলকাতার নগরপালের। বরং প্রশ্ন করায় রীতিমতো রেগে গেলেন। ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে উঠে এল আরও ভয়াবহ চিত্র। কিন্তু পুলিশের তদন্তে সেই দিশা নেই। একজনকে গ্রেফতার করেই দায় সারা ভাব। যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার নির্দেশ দিচ্ছেন পুলিশকে সঠিক দিশায় তদন্ত করতে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহল তা মানছেন না। ফলে আরও প্রশ্ন উঠছে। যার জবাব এখনও মেলেনি।
বারবার স্বাধীনতার মাসেই কেন হরন হচ্ছে স্বাধীনতা? যে স্বপ্নদীপ অনেক স্বপ্ন নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অকাল মৃত্যুর পর প্রশ্ন উঠল পুলিশের ভূমিকায়। ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধার পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। তবুও কাউকে আড়াল করার প্রচেষ্টা রয়েছে বলেই দাবি উঠেছিল সমাজের একাংশে। একই ঘটনা দেখা গেল আর জি কর কাণ্ডেও। এখানেও একজন সিভিক ভলান্টিয়ার ধরা পড়তেই পুলিশ দাবি করতে শুরু করেছে মূল চক্রী ধৃত। কিন্তু তরুণীর চিকিৎসকের দেহের ময়নাতদন্তে দেখা যাচ্ছে তাঁর দেহে রয়েছে একাধিক আঘাতের চিহ্ন। যৌনাঙ্গেও রয়েছে গভীর। পাওয়া গেল প্রায় ১৫০ গ্রাম মতো বীর্ষ। যৌনাঙ্গের ক্ষতচিহ্ন এতটাই গভীর যে পুলিশেরই একাংশের দাবি, একজন নয়, একাধিক ব্যক্তি ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত থাকার সম্ভাবনা প্রবল। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, বাকি অপরাধীদের কেন এখনও ধরা সম্ভব হল না? কেই বা হাসপাতালের সেমিনার হলের আশেপাশে সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেল না? যেটুকু সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে সঞ্জয় রায় নামে ধৃত ওই সিভিক ভলান্টিয়ার অবাধে হাসপাতালের চারতলায় সেমিনার হলের দিকে চলে গেলেন, এবং অপরাধ ঘটিয়ে ফিরেও এলেন। তাহলে কী অভিযুক্ত ওই হাসপাতালে অবাধে যাতায়াত করার অনুমতি ছিল? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি অডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে একজনকে দাবি করতে শোনা যাচ্ছে যে এর পিছনে যে বা যারা আছেন, তাঁদের মাথায় বড় কারও হাত রয়েছে। যদিও ভাইরাল হওয়া ওই অডিও ক্লিপের সত্যতা যাচাই করতে পারেনি নিউজ বর্তমান। তবে যা বলা হয়েছে, সেটা সত্যি না হলেও কিছু একটা তো ঘটেছিল। পুলিশ কেন সেই সত্যটা এখনও উদঘাটন করতে পারলো না? আর জি কর হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন রাজ্যের অন্যান্য হাসপাতালেও ছড়িয়ে পড়েছে।
এই আবহেই আর জি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষকে নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা। আর জি করের অধ্যক্ষ পদ থেকে সন্দীপ ঘোষ ইস্তফা দিয়েছেন বলেই জানা গিয়েছিল। তাঁকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয় যখন তিনি দাবি করে বসেছিলেন, কেন ওই তরুণী চিকিৎসক সেমিনার হলে একা ঘুমোতে গেলেন? তাহলে কি আর জি কর হাসপাতালের মতো মেডিকেল কলেজে মহিলাদের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে? এটা মেনে নিতে হবে সকলকে? প্রশ্ন তো অনেক, উত্তর কি আদৌ পাওয়া যাবে? যেমন আর জি করের অধ্যক্ষ পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই তাঁকে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হল। যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে স্বয়ং কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। এমনকি তাঁকে অবিলম্বে ছুটিতে পাঠানোর প্রাথমিক নির্দেশও দিয়েছে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। সবমিলিয়ে মেডিকেল কলেজের পড়ুয়া থেকে শুরু করে ইন্টার্ণ, সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে আর জি কর কাণ্ড নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠে এলেও নেই কোনও সদুত্তর। সবকিছু ছাপিয়ে এখন আরেকটা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তাহলে এবারও স্বাধীনতা দিবসের উৎসবের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাবে মহিলাদের স্বাধীনতা?
Discussion about this post