দুর্গাপুজো শেষ, এরপরই বাঙালি মেতে উঠবে দীপান্বিতা অমাবস্যার কালীপুজোয়। তবে তার আগের দিন অর্থাৎ কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিনটির গুরুত্বও কিছু কম নয়। কারণ এই দিনটিকে বলা হয় ভূত চতুর্দশী বা নরক চতুর্দশী। পুরাণ মতে, এই তিথিতেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বধ করেছিলেন নরকাসুরকে। লোক বিশ্বাস, এই তিথিতে স্বর্গ ও নরকের দ্বার কিছুক্ষণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সেই দরজা দিয়ে পরলোকগত আত্মারা মর্ত্যে ফিরে আসেন। পিতৃকুল ও মাতৃকুলের চোদ্দ পুরুষের অশরীরী আত্মা নেমে আসেন গৃহস্থের বাড়িতে। ঠিক যেমনটা মহালয়ার দিনে হয়। তবে পার্থক্য হল কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে নরকাসুর রূপী বলি রাজা তাঁর অসংখ্য অনুচর ভূত, পিশাচ, প্রেতদের নিয়ে মর্ত্যলোকে নেমে আসেন। আর সেই ভূত, পিশাচ, প্রেতাত্মাদের অভিশাপ থেকে বাঁচতে বা অশুভ শক্তিকে বাড়ি থেকে তাঁড়াতে ১৪টি প্রদীপ জ্বালানো হয়।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, বলি রাজা ছিলেন ভক্ত প্রহ্লাদের পৌত্র। তিনি অসম সাধনার জেরে পরম শক্তিশালী হয়েছিলেন এবং স্বর্গ, মর্ত্য এবং পাতালের অধিশ্বর হন। তাঁর বলে দেবতারাও লুকিয়ে বাঁচতেন। এমতবস্থায় দেবতারা ভগবান বিষ্ণুর দ্বারস্থ হন। বিষ্ণু তখন বামন অবতারে অবতার্ণ হয়ে বলি রাজার কাছে তিন পা জমি চাইলেন। বলি রাজা অহংকারের বশবর্তী হয়ে বামন দেবকে সেই জমি দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। বিষ্ণু নিজের স্বরূপ ধারণ করে দুই পায়ে স্বর্গ, মর্ত্য এবং পাতাল অধিকার করেন। কিন্তু তিন নম্বর পা কোথায় দেবেন? তখন বলি রাজা নিজের ভূল বুঝতে পেরে নিজের মাথা পেতে দেন বামন অবতারের চরণে। বিষ্ণুর পায়ের চাপে পাতালে প্রবেশ করেন বলি রাজ। সেই থেকে পাতালেই বসবাস করছেন বলি রাজা। তাঁর এই আত্মাহুতি দেখে শ্রীবিষ্ণু বলি রাজাকে অমরত্ব প্রদান করেছিলেন। সেই সঙ্গে এই বরও দেন যে, বছরে একটি দিন তিনি ভূত- প্রেতাত্মা- পিশাচ- অশরীরীর সঙ্গে এই পৃথিবীতে আসতে পারবেন। এই দিনটিই হল ভূত চতুর্দশী।
ভূত চতুর্দশী নিয়ে আরেকটি ব্যাখ্যাও আছে। পৃথিবী, জল, বায়ু, অগ্নি, আকাশ নিয়েই পঞ্চভূত। আবার মানবদেহও পঞ্চভূতের সমন্বয়ে গঠিত। মানুষের মৃত্যুর পর সেই দেহ আবার পঞ্চভূতেই বিলীন হয়। তাই ভূত চতুর্দশীর দিন পঞ্চভূতকেই সম্মান জানানো হয়। কিন্তু ১৪ প্রদীর জ্বালানো বা ১৪ শাক খাওয়ার রীতি রয়েছে ভূত চতুর্দশীর দিন?
আমাদের শাস্ত্রে ১৪ সংখ্যাটির গুরুত্ব অপরিসীম। উর্ধ্বলোকের সপ্তলোক অর্থাৎ ভূঃ ভূবঃ স্বঃ, জনঃ, মহঃ, তপঃ এবং সত্যলোক। আবার সপ্ত পাতাল অর্থাৎস অতল, বিতল, সুতল, তলাতল, মহাতল, রসাতল এবং পাতাল। এই দুই সাত মিলিয়ে হয় চোদ্দ লোক। ভূত চতুর্দশীর দিন এই চোদ্দলোকে সকল বিদেহী আত্মার জন্য ১৪টি প্রদীপ জ্বালানোর রীতি রয়েছে। আবার গণিতের ভাষায় যদি বলি, ৯ আর ৫ যুক্ত করলেও হয় ১৪। মানব দেহের নয়টি ছিদ্র তথা দুই চোখ, দুই নাসিকা ছিদ্র, দুই কানের ছিদ্র, মুখ গহ্বর, পায়ুদ্বার এবং লিঙ্গ। এর সঙ্গে পঞ্চভূত মিলিয়ে হয় চোদ্দ। মানব শরীরের এই চোদ্দটি দিকগুলিকে জাগ্রত করার প্রতীক হিসেবেও ১৪ প্রদীপ জ্বালানোর বিধান। এবার আসি চোদ্দ শাক খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে। আগে বলি কোন ১৪টি শাকপাতা খাওয়ার বিধান রয়েছে। সেগুলি হল ওল, ভাটপাতা, কেঁউ, শৌলফ, শাঞ্চে, কালকাসুন্দে, পলতা, বেতো, সর্ষে, নিম, গুলঞ্চ, শুষণী, হিঞ্চে এবং জয়ন্তী। আসলে শাক সারাবছরই পাওয়া যায় আমাদের গ্রাম বাংলায়। আর কালীপুজোর সময়টা হল আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়। তাই শাকপাতা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তাই ১৪ শাক খাওয়ার বিধান দেওয়া হয়েছে।
Discussion about this post