বহু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে মা
তুমি বিল্বপত্তন গ্রামে।
ভৃগুর শক্তিপীঠ আজ
বড় বেলুন নামে।।
প্রাচীন এক মহাশ্মশান, তার পাশে বিল্ব অর্থাৎ বেল এবং বটের বন। এই ঘন বনের আশেপাশে গড়ে ওঠে এক জনপদ। কালক্রমে এই গ্রামের নাম হয় বিল্বপত্তন। বর্ণ বিপর্যয়ের জেরে সেই বিল্বপত্তন আজ বড়বেলুন নামে খ্যাত হয়েছে। পূর্ব বর্ধমানের ভাতারের অন্যতম প্রাচীন গ্রাম সেই বড়বেলুনের “বড় মা” অর্থাৎ মা কালীর পুজো গোটা জেলার অন্যতম দ্রষ্টব্য। আজ আপনাদের শোনাবো সেই বিখ্যাত কালীপুজোর গল্প। জানা যায় এই পুজোর সূচনা করেছিলেন সাধক ভৃগুরাম। তাও প্রায় ৬০০ বছর আগে। কেতুগ্রামের বহুলা পীঠ এলাকায় বসবাস করতেন ভৃগুরাম নামে এক সাধক। তিনি অকৃতদার এবং দিনরাত মা কালীর সাধনায় ব্রতী থাকতেন। তিনিই মায়ের সপ্নাদেশ পেয়ে বিল্বপত্তন গ্রামে এসে ঘোর তন্ত্রসাধনায় মগ্ন হন। ওই সাধককে বুড়োগোঁসাই নামে ডাকা হত। আরেক তান্ত্রিক সাধক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সেই কাহিনী সুন্দর ভাষায় লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।
কেতুগ্রামে বহুলাপীঠে শক্তি সাধনায়।
ভৃগুরাম যোগাসনে ডাকতেন মহামায়ায়।।
স্বপ্নাদেশ দিলেন মাতা, পুত্র ভৃগুরামে।
গমন করো তুমি বিল্বপত্তন
মহা শ্মশান ধামে।।
এই স্বপ্নাদেশ পেয়ে সাধক ভৃগুরাম চলে আসেন বিল্বপত্তন গ্রামের মহাশ্মশানে। একটি পর্ণ কুঠির নির্মাণ করে তিনি সাধনা করতেন। কথিত আছে, তিনি প্রতিদিন মায়ের মাটির মূর্তি গড়ে পূজা করতেন। একদিন সাধক মায়ের মূর্তি গড়ে স্নান করতে গিয়েছেন। ফিরে এসে দেখলেন সেই মূর্তি নেই। খোঁজাখুঁজি করতেই তাঁর সামনে প্রকট হল এক বিরাটকায় বিকট এক নারী মূর্তি। তালপাতার চাউনি ভেদ করে তিনি ভৃগুরামের সামনে দাঁড়িয়ে। ওই বিশাল নারীকে দেখে ভয় পেয়ে যান ভৃগুরাম। তিনি সেই স্থান থেকে পালাতে উদ্যত হলে মা স্বয়ং তাঁকে অভয়বাণী শোনান। সাধক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন,
এক হস্তে মূর্তি গড়ি ভৃগু একদিন।
স্নান সেরে এসে দেখে নাহি তাঁর চিন।।
কোথা গেল সেই মূর্তি, সেই বেদি পরে।
ভীষণা বদনা মাতা দাঁড়িয়ে আছেন ঘরে।।
অভয় দিয়ে মাতা বলেন, ওরে ভৃগুরাম।
এই মূর্তি থাকবে আমার, বুড়িমাতা নাম।।
স্বয়ং মায়ের আদেশ পেয়ে ভৃগুরাম ১৪ হাত উঁচু মূর্তি গড়লেন। এরপর সেই মায়ের সাধনায় লীন হলেন। এরপর আরেকবার তিনি মায়ের স্বপ্নাদেশ পান। ‘এবার বিয়ে-থা করো। তোমার অবর্তমানে আমার পুজো কে করবে?’ মা আরও বলেন- ‘সামনের অমাবস্যায় এক ব্রাহ্মণকন্যা সর্প দংশনে মারা যাবে, তাকে মহাশ্মশানে নিয়ে এলে তুই একমুঠো ছাই তার মুখে দিয়ে দিবি, সঙ্গে সঙ্গে সে প্রাণ ফিরে পাবে, তারপর তুই তাকে বিয়ে করে সংসারী হবি’। তারপর দেবীর কথামতো ঘটল সেই ঘটনা, একদিন বিল্বপত্তনের রাজা নারায়ণ চন্দ্র রায়ের কুমারী কন্যা সর্পাঘাতে মারা যান। সেই রাজকন্যার দেহ বড়বেলুনের শ্মশানে নিয়ে আসা হয় দাহ করার জন্য। ভৃগুরাম মৃতদেহের ওপর শ্মশানের চিতাভষ্ম ছিটিয়ে দিলে আশ্চর্যভাবে বেঁচে ওঠেন রাজকন্যা। শববহনকারীরা পরে এসে দেখেন মৃতা রাজকন্যা জীবিত। কিন্তু সেই পুনর্জন্ম পাওয়া মেয়েকে আর তাঁর পরিবার ও সমাজ নিতে চায়নি। ওই মেয়েকেই বিয়ে করার জন্য ভৃগুরাম স্বপ্নাদেশ পান। পরবর্তীকালে সাধক ভৃগুরামের সন্তানরাই এই মন্দিরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বড়বেলুন গ্রামের বড় মায়ের মূর্তি ১৮ হাত লম্বা। ভৃগুরামের বংশধরেরাই ২১ পুরুষ ধরে এই পুজো করে আসছেন। দেবীর জ্বিহা তৈরি করা হয় বিশাল এক কুলো দিয়ে। এই পুজোর প্রাচীন রীতি হল মায়ের মূর্তিতে রঙ করা শুরু হয় কালীপুজোর দিনে। সন্ধ্যায় মাকে ডাকের সাজে সাজানো হয়। মশালের আলোতে হয় গোটা পর্ব। সারারাত পুজো করা তন্ত্রমতে। এখানে বলিপ্রথা রয়েছে। মায়ের মাহাত্ম্য এতটাই ছড়িয়েছে যে পূর্ব বর্ধমান জেলা-সহ দূর দূরান্তের জেলা থেকেও ভক্তরা ছুটে আসেন। ভাতৃদ্বিতীয়ার দিন মায়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে রথে চড়িয়ে স্থানীয় দিঘিতে মায়ের নিরঞ্জন হয়।
Discussion about this post