১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোনে ওড়িশা সরকারের হিসেবেই কমবেশি ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সেই রাজ্যে। এরপর কেটে গিয়েছে দুই দশকের বেশি সময়। আর এই সময়কালে ফি বছর নিয়ম করে ওড়িশা বা বাংলার বূকে আছড়ে পড়েছে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়। এরমধ্যে কোনওটা বিধ্বংসী রূপ নিয়েছে, কোনওটা আবার সামান্য ক্ষতচিহ্ন রেখে গিয়েছে। কিন্তু ১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোনের পর ওড়িশা সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা মডেল কোনওবারই ক্ষয়ক্ষতি করতে দেয়নি কোনও ঘূর্ণিঝড়কে। যে মডেলটি তৈরি করেছিলেন স্বয়ং নবীন পট্টনায়কের নেতৃত্বাধীন বিজেডি সরকার। বর্তমানে ওড়িশা থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে বিজেডি। দীর্ঘ কয়েক দশক পর মুখ্যমন্ত্রিত্ব খুঁইয়েছেন নবীন পট্টনায়ক। কিন্তু তাঁর দেখানো পথেই এবারের প্রবল ঘূর্ণিঝড় ডানার মোকাবিলা করল ওড়িশার বর্তমান বিজেপি সরকার। আর তাতেই এল সাফল্য। এখনও পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় ডানার ফলে একজনেরও মৃত্যুর খবর আসেনি। ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতির পরিমানও অতি সামান্য।
প্রসঙ্গত, ২০০০ সালে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন নবীন পট্টনায়ক। তার ঠিক আগের বছরই ওড়িশার বুকে ঘটে গিয়েছে শতাব্দীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ওড়িশা উপকূলে আছড়ে পড়েছিল সুপার সাইক্লোন। নবীন পট্টনায়ক যখন মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসেন, তখনও সুপার সাইক্লোনের ক্ষত শুকায়নি। ফলে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য স্থায়ী সমাধান কিছু বের করতে হবে। কারণ, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া বেশিরভাগ ঘূর্ণিঝড়ই ওড়িশার দিকেই ধেয়ে আসে। তাই স্থায়ী পরিকাঠামো তৈরির জন্য কোমর বেঁধে নেমেছিলেন নবীন পট্টনায়ক। ২০০১ সালেই তিনি গঠন করেন ওড়িশা ডিজাস্টার অথরিটি বা ওএসডিএমএ। এর অনেক পড়ে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী গঠিত হয়। ফলে বলা যায় বিপর্যয় মোকাবিলায় নবীন পট্টনায়কই পথ দেখিয়েছিলেন গোটা দেশকে। এর সবচেয়ে বড় প্রমান হল, ২০২১ সালের ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। এই বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় নবীন পট্টনায়কের সাফল্যকে কুর্নিশ জানিয়েছিল স্বয়ং রাষ্ট্রসংঘ।
১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোনের পরবর্তী ২০ বছরে ওড়িশায় ৮১৫টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র বা ফ্লাডসেল্টার তৈরি হয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলির সংখ্যা আরও বাড়ছে। এই বহুমুখী ত্রাণশিবিরে সবধরণের সুযোগসুবিধা যেমন আছে, তেমনই এগুলি যথেষ্ট শক্তপোক্ত। ফলে কোনও ঘূর্ণিঝড় অথবা বন্যার সময় এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলিতে দ্রুততার সঙ্গে গ্রামবাসীদের নিয়ে আসা যায়। এর ফলে প্রাণাহানী ঠেকানো অনেকটাই সহজ হয়েছে। অপরদিকে, নবীন পট্টনায়কের আমলে ওড়িশায় গ্রামস্তরে ৪০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবককে নিয়মিত ট্রেনিং দেওয়া হয়। যাতে যে কোনও সময় যে কোনও বিপর্যয়ে তাঁরা দ্রুত দক্ষতার সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। এই স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে আছেন স্থানীয়স্তরে মিশন শক্তি সদস্য, আশা ও অঙ্গনওয়ারি কর্মী, ভানা নিরাপত্তা সমিতি বা ভিএসএস, স্থানীয় পঞ্চায়েতের কর্মীরা।
সেই সঙ্গে ওড়িশা বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, দমকল বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ বাহিনী, এনডিআরএফ সমন্বয়সাধন করে কাজ করে। ফলে ওড়িশার বুকে যতই প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসুক না কেন, প্রাণহানির ঘটনা খুব কম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আইলা, ফনি, ইয়াসের কবলে ওড়িশায় মৃতের সংখ্যা অতি নগন্য। আবার ২০২২ সালে মহানদী, সুবর্ণরেখা ও বৈতরণী নদীর অববাহিকায় ভয়াবহ বন্যার সময় দ্রুততার সঙ্গে ২৭ লক্ষ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া গিয়েছিল। আর এবার ঘূর্ণিঝড় ডানায় একজনেরও মৃত্যু হয়নি ওড়িশায়। যেখানে পশ্চিমবঙ্গে একজনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়। আর ওড়িশার এই সাফল্য পুরোটাই নবীন পট্টনায়কের। যতই বর্তমান বিজেপি সরকার এই সাফল্য নিজেদের বলে দাবি করুক না কেন।
Discussion about this post