অদ্ভুত এই বঙ্গ আরও অদ্ভুত এই বঙ্গের কালীক্ষেত্র। কত রূপে, কত ভাবে যে মা কালী এখানে বিরাজমানা তার ইয়াত্তা নেই। আমরা সাধারণত ঘোর কৃষ্ণবর্ণা বা কালো রঙের কালী, বা নবঘনশ্যাম বা নীল বর্ণের কালীমূর্তিই দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু কোথাও কখনও শুনেছেন দুর্বাদলশ্যাম সবুজ বর্ণের কালী প্রতিমার কথা? ওই যে আগেই বলেছি, এই বঙ্গে সবই সম্ভব। হুগলি জেলার নালিকূল স্টেশনে নেমে শিয়াখালা যাওয়ার অটো ধরে বসুন, এরপর নারকেলতলা স্টপেজে টুক করে নেমে পড়লেই হল। সেখান থেকে সামান্য পায়ে হেঁটে ঠনঠনেপাড়ায় অধিকারী বাড়ির সবুজ কালী দেখতে পাবেন। সবুজ রঙের কালী? কেন এমন রূপ? সেটা জানতে হলে আপনাকে পিছিয়ে যেতে হবে ৭০ বছরের বেশি সময়কালে।
চারিদিকে নিঝুম আঁধার, কাছে-দূরে শোনা যাচ্ছে শিয়ালের রব, প্যাঁচার ডাক। রাতের দিকে এই অঞ্চলে কেউ ঢোকে না। এই বনে দুই-একটা হিংস্র এবং ক্ষুধার্ত শ্বাপদ থাকতেই পারে। কিন্তু সব কিছুকেই উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছেন বটকৃষ্ণ অধিকারী। তিনি ঘোর বৈষ্ণব, মুখে তাই কৃষ্ণ নাম। কৃষ্ণ নাম স্মরণ করেই ভয় দূর করছেন আর হন হন করে এগিয়ে চলেছেন বন-জঙ্গল ভেদ করে। অনেকটা যাওয়ার পর দূর থেকে সামান্য আলো দেখতে পেলেন বটকৃষ্ণ। ওটাই তাহলে সন্নাসী ঠাকুরের পর্ণ কুটির। সেই দিন দুপুরেই মাঠে গরু চড়ানোর সময় তাঁকে দেখা দিয়েছিলেন এই সন্নাসী ঠাকুর। বলেছিলেন বনের ভিতর তাঁর পর্ণ কুটিরে আসতে। কে জানে কোন টানে সে ছুটে চলেছে এই গভীর রাতে।
বটকৃষ্ণ অধিকারীর জন্ম এক বৈষ্ণব পরিবারে। তাই ছোট থেকেই কৃষ্ণ নাম নিয়ে বড় হয়ে ওঠা। সেই সময় ম্যাট্রিকুলেশন পাশও করেছিলেন। তবুও কাজকর্মে তাঁর মন ছিল না। পরিবারের চাপে ভিন রাজ্যে কাজ নিয়ে চলে যান। কয়েকদিন পরই কাজের পাট চুকিয়ে ফিরে আসেন। গ্রামে ফিরে চাষাবাদ করতে শুরু করেন, সব ঠিকঠাক চলছিল। এরপর এক প্রকার জোর করেই তাঁর পরিবার আঙুরবালা দেবীর সাথে বিবাহ দিয়ে দিলেন। কিন্তু সংসারে তাঁর মতি ছিল না। মাঠে ঘাটে শ্মশানে ঘুরে বেড়াতেন, সঙ্গে থাকতো তাঁর আড়বাঁশি। যাতে সুর তুলতেন কৃষ্ণের মতোই। একদিন সেই সন্নাসী ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল, তিনি বলেছিলেন অমুক স্থানে অমুক সময়ে তোমার দীক্ষা হবে। সেই জন্যই গভীর রাতে সেই বনে ছুটে গিয়েছিলেন বটকৃষ্ণ অধিকারী, এবং দীক্ষা সম্পূর্ন করে সেই শ্মশানেই সাধনা করেন এবং সিদ্ধিলাভ করেন।
একজন পরম বৈষ্ণব বটকৃষ্ণ অধিকারী হয়ে উঠলেন ঘোর কালীসাধক। কিন্তু কুলীন বৈষ্ণব পরিবার কেন মেনে নেবেন তাঁর কালীসাধনা বা শক্তিসাধনা? তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজও তা মেনে নেয়নি। ফলে তিনি সকলকে লুকিয়ে ঘরের এক কোনে ঘট স্থাপন করেই মা কালীর উপাসনা করতে শুরু করলেন। আর শ্মশানে চলল তাঁর সাধনা। এরকমই একদিন অমাবস্যা তিথিতে সেই শ্মশানেই সাধক বটকৃষ্ণ অধিকারী দেখা পেলেন মা কালীর। মায়ের একই অঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ এবং মা কালী মিলেমিশে একাকার। কৃষ্ণকালী। দৈববাণী হয়, তোমরা যে আমাদের ভেদ জ্ঞান করছ, আমরা আলাদা নই। আমরা এক এবং অভিন্ন। এরপরই বটকৃষ্ণ দেখলেন সেই অপূর্ব দৃশ্য। শ্রীকৃষ্ণ ও মা কালীর মূর্তি একই অঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে এক নারী মূর্তিতে পরিবর্তিত হল। কিন্তু এ কি! এ তো কালো বা নীল নয়, এ তো দুর্বাদলশ্যামা। দেবীর গায়ের রং একেবারে সবুজ। তখনই ফের দৈববাণী হল, এই রূপেই তুমি আমাদের প্রতিষ্ঠা কর আমরা উভয় থাকব তোমার কাছে।
বৈষ্ণব বাড়িতে মা কালীর আরাধনা। তাই একই অঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ ও কালীর রূপ এই সবুজ কালী। প্রথম থেকেই তাই সাধক বটকৃষ্ণ অধিকারী কালীপুজো করার সময় মাকে বাঁশির মধুর সুর শোনাতেন। সেই রীতি আজও চলে আসছে বংশপরম্পরায়। যদিও গুপ্ত তন্ত্র মতেই এখানে মায়ের পুজো হয় বলে জানালেন বর্তমান সেবায়েত। হুগলির হরিপাল থানার নালিকূলের অধিকারী বাড়ির সবুজ কালী পুজোয় অনেকেই ভূত চতুর্দশীর দিন চোদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে মানত করেন। বিশ্বাস এটা করলেই ইচ্ছাপূরণ হয়। ফলে বহু ভিড় জমে এই দিন। দীপান্বিতা অমাবস্যায় বিশেষ ষোড়শ উপাচারে পুজো হয়। হোমও হয়। পুজোর রাতে টানা তিন ঘণ্টা বাঁশি বাজিয়ে শোনানো হয়। রাত ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত একটানা বাজে বাঁশি। ওই দিন মা কালীর ভোগে আবশ্যই থাকে ইলিশ মাছ।
Discussion about this post