দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার একটি বিখ্যাত মন্দিরে প্রচুর পশু বলি দেওয়া হয়। আর সেই পশু বলি বন্ধের আবেদন জানিয়ে একটা জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে। সোমবার মামলাটি উঠেছিল বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসু এবং বিচারপতি অজয়কুমার গুপ্তের অবকাশকালীন বেঞ্চে। শুনানির সময় দুই বিচারপতির বেঞ্চের মন্তব্য, “যদি গোটা পূর্ব ভারতের সকলকে নিরামিষাশী করা মামলাকারীর চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়, তবে তা সম্ভব নয়। পাশাপাশি বিচারপতিরা জানতে চান, মামলাকারী কি শুধু একটি মন্দিরের ক্ষেত্রেই এই নিষেধাজ্ঞা চান? না কি সামগ্রিক ভাবে পশুবলি বন্ধ করার আবেদন নিয়ে এই জনস্বার্থ মামলা?
জবাবে মামলাকারীর আইনজীবী জানান, শুধুমাত্র একটি মন্দিরকে কেন্দ্র করেই এই মামলা। পাশাপাশি সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে জরুরি ধর্মীয় আচার পালনের অধিকারের মধ্যে এই পশুবলির রেওয়াজ পড়ে না বলেও আদালতে জানান তিনি। দুই বিচারপতির বেঞ্চের প্রশ্ন, “আপনি এটি কী ভাবে বলতে পারেন? আপনি কী ভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন? আপনি কিসের ভিত্তিতে বলছেন এটি জরুরি ধর্মীয় আচারের মধ্যে পড়ে না? বাংলার এই অঞ্চলে এবং পূর্ব ভারতে ধর্মীয় আচারের সঙ্গে উত্তর ভারতের ধর্মীয় আচার সম্পূর্ণ এক নয়। এমনকি পৌরাণিক চরিত্রেরা আদৌ নিরামিষ খেতেন না আমিষ খেতেন, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে”। আদতে এই প্রশ্নেই গোটা সমাজ আজ দ্বিধাবিভক্ত। সমাজের একটা অংশ হিন্দু দেব-দেবীর পুজোয় পশু বলি বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন অমানবিকতার অজুহাতে। অপরদিকে সমাজের আরেকটা অংশ এই বলি প্রথাকে ধর্মীয় আচার বলে পূর্ণ আস্থা রাখছেন। আসুন একটু জানার চেষ্টা করা যাক হিন্দু শাস্ত্রগুলিতে বলি প্রথা নিয়ে কি বলা আছে।
হিন্দু শাস্ত্র ও পুরাণে পশুবলি ও সাত্ত্বিকবলি দুইয়েরই বিধানই দেওয়া হয়েছে। আসলে হিন্দু পূজা পদ্ধতি প্রধানত দুইটি ধারায় বিকশিত প্রথমটি বৈদিক এবং দ্বিতীয়টি তান্ত্রিক শাস্ত্রাচার পদ্ধতি। এই দুটি পদ্ধতিতেই পশুবলির বিধান দেওয়া আছে। আবার সারা পৃথিবীর হিন্দু সম্প্রদায় প্রধানত তিনটি প্রধান মতে বিভক্ত। শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব। এর মধ্যে বৈষ্ণব মতে সাত্বিকবলির প্রচলন রয়েছে, বাকি দুটি মতে পশুবলি বৈধ। শাক্ত মতের অন্যতম প্রধান গ্রন্থ মার্কন্ডপুরাণের অর্ন্তগত শ্রীশ্রীচণ্ডীর দ্বাদশ অধ্যায় পশু বলির কথা উল্লেখ রয়েছে। একইভাবে শৈবদের গ্রন্থাবলীতেও পশুবলির বিধান আবশ্যকীয়ভাবে দেওয়া আছে।
অপরদিকে, শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম স্কন্ধের ১৩ অধ্যায়ে বলা হয়েছে শাস্ত্রে দেবোদ্দেশে পশুবধের বিধান থাকলেও বৃথা হিংসার বিধান নেই। একইভাবে মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে দেবোদ্দেশং বিনা ভদ্রে হিংসা সর্বত্র বর্জয়েৎ। অর্থাৎ, দেবোদ্দেশে বলিদান উৎসর্গ ব্যতীত সর্বত্রই হিংসা বর্জন করতে হবে। হিন্দুদের বিশ্বাস, বলিকৃত পশু সকল বন্ধন মুক্ত হয়ে মুক্তিলাভ করে। যদিও শাস্ত্রকারদের ব্যাখ্যা, মানুষের ষড়রিপুর নাশের প্রতীক হিসেবেই পশুবলি দেওয়া হয়। যেমন পাঠা হল অনিষ্টকর কামের প্রতীক, মহিষ হল ক্রোধের প্রতীক। তবে পশুবলি হয়তো প্রতিকী, কিন্তু সত্যিকারের পশুবলি দেবতার উদ্দেশ্যে আমরা তখনই দিতে পারবো যখন সত্যিসত্যি আমরা আমাদের দেহ থেকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য রূপ শরীরস্থ এই ষড়রিপুকেই বিনাশ করে পশুত্ব থেকে প্রথমে মনুষ্যত্ব এবং অন্তে দেবত্বে পৌঁছতে পারবো। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মতসয্য এই ষড়রিপুকে একত্রে ছাগ বলে। ছাগ বলি দেওয়ার অর্থ নিজেকে ভগবানের নিকট সমর্পণ করে এই ষড়রিপু গুলিকে ভগবানের সামনে ত্যাগ করা।
Discussion about this post