গত জুন-জুলাই মাসে যখন বাংলাদেশে কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দলোন চলছে, গোটা বাংলাদেশ যখন হিংসার আগুনে জ্বলছে। তখন থেকেই ভারত বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য ভিসা দেওয়ার প্রক্রিয়া কমিয়ে দিয়েছিল। এরপর ৫ আগস্ট বাংলাদেশে যখন গণঅভ্যুত্থান হল এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে এসে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হয়। ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের অধিকাংশ অফিসার-কর্মীদের বিশেষ বিমানে ফিরিয়ে আনে নয়া দিল্লি। এরপরই ভারত ভিসা প্রদান কিছুদিনের জন্য পুরোপুরি বন্ধ রাখে। পরে তা সীমিত আকারে চালু হয়েও এখনও পর্যন্ত স্বাভাবিক হয়নি বলেই খবর। ভারত সরকার বাংলাদেশি নাগরিকদের একমাত্র জরুরি মেডিকেল ভিসা প্রদান করছে। বাকি সব ধরণের ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। ফলে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে গেদে-দর্শনা, বেনাপোল-পেট্রাপোল, হিলি সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন যখন কয়েক হাজার যাত্রী পারাপার করতেন, এখন সেটা নেমে এসেছে কয়েকশোতে।
যে কয়েকজন আসছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই জরুরি চিকিৎসাজনিত কারণে ভারতে আসছেন। আগে একজন রোগীর সঙ্গে বেশ কয়েকজন করে ভারতে ঢুকতেন, এখন একজন রোগী পিছু একজন বা দুইজনকে ছাড় দিচ্ছে ভারত সরকার। সম্প্রতি হিন্দু সন্নাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস-সহ কয়েকজন হিন্দু নেতার গ্রেফতার এবং ঢাকার প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারে ভারতের জাতীয় পতাকার অবমাননার অভিযোগের পর ভিসা প্রদান আরও কমিয়েছে ভারত। শুধু তাই নয়, কলকাতার কয়েকজন নামি চিকিৎসক এবং কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল আবার বাংলাদেশি রোগী বয়কট করা শুরু করেছে। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে শুরু করেছে।
এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভালো, ভারতের উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা পেতে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলি যেমন, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমান নাগরিক ভারতে আসেন মেডিকেল ভিসা নিয়ে। সাম্প্রতিককালের একটা পরিসংখ্যান যথেষ্টই চমকে দেওয়ার মতো। তা হল, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে মেডিকেল ভিসা পেয়ে ছিল ৩, লক্ষ ৪ হাজার ৬৭ জন বাংলাদেশি নাগরিক। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে মেডিকেল ভিসা প্রদানের হার বেড়েছিল প্রায় ৪৭.৯ শতাংশ। অর্থাৎ অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় বাংলাদেশীদের ভারতে চিকিৎসা করানোর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। ২০২৩-২০২৪ সালে শ্রীলঙ্কান নাগরিকদের জন্য কেবলমাত্র ১,৪৩২টি মেডিকেল ভিসা দেওয়া হয়েছিল। মিয়ানমারের নাগরিকরা ৩,০১৯ জন মেডিকেল ভিসা পেয়েছেন, মালদ্বীপের ১,৬৪৫ জন এবং পাকিস্তানের মাত্র ৭৬ জন মেডিকেল ভিসা নিয়ে ভারতে এসেছিলেন চিকিৎসা করাতে। এছাড়া, নেপাল ও ভুটানের বহু নাগরিকও ভারতে আসেন দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা করাতে।
বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমারের নাগরিকদের প্রথম পছন্দ কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলি। পাশাপাশি দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি নামি চিকিৎসা কেন্দ্রেও অনেকে আসেন। তবে একটা বিষয় পরিস্কার, দিন দিন ভারতে মেডিকেল পর্যটনের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছিল। যা ধাক্কা খেল বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের জেরে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা ভিসা নিয়ে ভারতে এসেথিলেন ১ লক্ষ ৮৩ হাজার মানুষ। ২০২১ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে হয় ৩ লক্ষ ৪ হাজার, ২০২২ সালে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লক্ষ ৭৫ হাজারে। ২০২৩ সালেই বাংলাদেশি নাগরিকদের মেডিকেল ভিসার ৬ লক্ষ ৩৫ হাজার আবেদন মঞ্জুর হয়েছিল বলে ভারতের ব্যুরো অফ ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা যাচ্ছে। এই সংখ্যাটা চলতি অর্থ বছরে আরও বাড়তে পারতো। কিন্তু বাংলাদেশে গণ অভ্যুত্থানের জেরে যা ধাক্কা খেয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, কলকাতার বড় মাঝারি বেসরকারি হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা কমেছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। বাইপাসের ধারের অ্যাপেলো হাসপাতাল, রুবি জেনারেল হাসপাতাল, বি পি পোদ্দার, মণিপাল, মেডিকার মতো নামি দামি প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশি রোগীতে ভিড় থাকতো। এখন সেখানে হাতে গোনা কয়েকজনের চিকিৎসা চলছে।
এরমধ্যেই পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেয়। বাংলাদেশে চলতে থাকা অশান্তির মাঝে সে দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের খবর, বাংলাদেশে ইসকনকে নিষিদ্ধ করার দাবি, সন্নাসী চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভু-সহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারের ঘটনা ঘটে। আবার ঢাকার প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে ভারতের জাতীয় পতাকা এঁকে তার উপর দিয়ে হাঁটার ছবি ভাইরাল হয়। যা নিয়ে কলকাতার কয়েকজন চিকিৎসক এবং কয়েকটি হাসপাতাল বাংলাদেশি রোগী বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। যার মধ্যে অন্যতম, উত্তর কলকাতার মানিকতলা এলাকার জেএন রায় হাসপাতাল। এই ধারাবাহিকতা যদি আরও কয়েকটা দিন থাকে, তাহলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা করাতে আসা কার্যত বন্ধ হয়ে যাবে বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। যা নিয়ে ওপার বাংলার জনমানসে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে।
Discussion about this post