বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, যিনি শেখ হাসিনা পরবর্তী সময়ে দেশের শাসনভার হাতে নিয়েছিলেন। যদিও কয়েকঘন্টার সেই শাসনকাল এখন রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। অনেকেই বলছেন, শেখ হাসিনা ঘনিষ্ট সেনাপ্রধানকে কার্যত বিশ্বাসই করতে পারছেন না প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস এবং তাঁর উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্যরা। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা একেবারেই জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে সেনাপ্রধান চাইছেন না। তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার বহু চেষ্টা হয়েছে বিগত চার মাসে। কিন্তু সেই কাজটা আদতে হয়নি। কেন তাঁকে বিশ্বাসঘাতক মনে করছেন বাংলাদেশের একাংশ? আদৌ কি তিনি হাসিনা ঘনিষ্ট বা হাসিনার আত্মীয় বলে এই অবিশ্বাস?
গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছিলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সব দলের সাথে আলোচনা করে তারা একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এবং সেই সরকারের মাধ্যমেই দেশ পরিচালনা করা হবে। কিন্তু সেই সময় প্রশ্ন ওঠেনি, শেখ হাসিনা কেন ও কার মদতে সেনা হেলিকপ্টার ও বিমানে চেপে দেশ ছাড়তে পারলেন? কে বা কারা তাঁকে ভারত পর্যন্ত নিরাপদে পৌঁছে দিলেন। এই প্রশ্নও ওঠেনি, তাঁকে কেন আটক করা গেল না? অনেকে বলছেন আসলে সেই সময় সকলেই বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা নিয়ে উৎফুল্ল ছিলেন। সকলেরই ফোকাস ছিল স্বরাচারী হাসিনার পতন ও নতুন বাংলাদেশ গঠন। কিন্তু, পরে উপরিউক্ত প্রশ্নগুলিই ঘুরপাক খেতে শুরু করে বাংলাদেশের জনমানসে। আর এই প্রশ্নেই বিদ্ধ হচ্ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও সমণবয়করা। তখন থেকেই সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়ে একটা অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়।
গণ অভ্যেউত্থানের মাত্র ২ মাস আগে, অর্থাৎ গত জুন মাসে সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। বিগত চার দশক ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদে তিনি যেমন কাজ করেছেন, তেমনই দুই বছর কাজ করেছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিরক্ষাবাহিনীতে। কিন্তু এমন একটা সময়ে তাঁকে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যে সময় কার্যত ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল তাঁর দেশ। কারণ হিসেবে অনেকেই বলে থাকেন, ওয়াকার উজ-জামানের সঙ্গে হাসিনার আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমানের কন্যা বেগম শারহনাজ কমলিকা রহমানের স্বামী ওয়াকার উজ-জামান। মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনার চিফ অব আর্মি স্টাফ ছিলেন। এই মুস্তাফিজুর আবার শেখ হাসিনার সম্পর্কে কাকা। অর্থাৎ হাসিনার খুড়তুতো বোন শারহনাজ কমলিকা রহমানের স্বামী ওয়াকার উজ-জামান।
জানা যায়, গত ৫ আগস্টের দিন এই ওয়াকার উজ জামানই শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানাকে নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ উঠেছে, গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের বহু গণ্যমাণ্য ব্যক্তি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও তাঁদের পরিবার-সহ প্রায় ৬২৬ জনকে বিভিন্ন সেনানিবাসে নিরাপদ ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল। পরে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলে, ৬১৫ জন সেনানিবাস ত্যাগ করেন। আর মাত্র ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বাকি সাতজন নাকি এখনও সেনানিবাসেই লুকিয়ে আছে। বাংলাদেশের অনেকেই সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২১২ ধারায় ‘অপরাধীকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে মামলা করার দাবি জানিয়েছেন। ওই ধারায় বলা হয়েছে, কখনও কোনও অপরাধ সংগঠিত হইলে, এইরূপ কোন ব্যক্তিকে আইনানুর শাস্তি হইতে লুকাইবার অভিপ্রায়ে আশ্রয় দান করে বা লুকাইয়া রাখে, যাহাকে সে অপরাধী বলে জানে বা অপরাধকারী বলিয়া বিশ্বাস করিবার কারন থাকে। এই ধারাটি তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা উচিৎ।
শেখ হাসিনা ও তাঁর বোনের দেশত্যাগ করতে কে সাহায্য করেছিলেন, তা অবশ্য সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে, এই ব্যাপারে যে সেনাপ্রধানের দিকেই আঙ্গুল উঠছে, তা বলা যায়। তিনি শেখ হাসিনার আত্মীয় এবং অত্যন্ত ঘণিষ্ঠ বলে পরিচিত। আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর এক সাংবাদিক বৈঠক করেন ওয়াকার-উজ-জামান। সেখানে তিনি বলেন, পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার গঠন নিয়ে তিনি রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে জামায়াতের আমির, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দ, জুনায়েদ সাকী ও ডঃ আসিফ নজরুল উপস্থিত ছিলেন। তবে বৈঠকে আওয়ামী লীগের কেউ ছিলেন না। প্রশ্ন উঠছে, জামাত তখনও বাংলাদেশে নিষিদ্ধ এক সংগঠন। ফলে জামাতের আমির কিভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে স্থান পেলেন? সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের গতিবিধি নিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের মধ্যে একটা অবিশ্বাসের বাতাবরণ রয়েছে।
Discussion about this post