এ দেশে পা রেখে ওঁরা মৈত্রীর কথা বললেন। বন্ধুত্বের কথা শোনালেন। দীর্ঘদিনের সুসম্পর্কের কথাও মনে করাতে ভুললেন না। কিন্তু কাঁটাতারের ওপারে যে ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিদিন, তার কড়া সমালোচনা সে ভাবে শোনা গেল না তাঁদের মুখে। বরং ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বা ‘রাজনৈতিক বিষয়’ বলেই যেন বিতর্ক এড়িয়ে যেতে চাইলেন তাঁরা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানি সেনা। সেই ঘটনাকে মনে রেখেই প্রতি বছর ‘বিজয় দিবস’ পালন করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। এ বছর বিজয় দিবস উপলক্ষে কলকাতায় এসেছেন বাংলাদেশের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মহম্মদ আমিনুর রহমান এবং ন’জন মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবার। বিজয় দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার রাজভবনে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের উপস্থিতিতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন তাঁরা। ছিলেন ’৭১ সালের যুদ্ধে অংশ নেওয়া একাধিক অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনাকর্তাও। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হলেও সেখানে অবধারিত ভাবেই উঠল বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির প্রসঙ্গ। বাংলাদেশি অতিথিরা মনে করেন, দু’দেশের মধ্যে তিক্ততার আবহ তৈরি হলেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে তা কোনও স্থায়ী ক্ষত তৈরি করতে পারবে না। যা ঘটছে, তা ‘সাময়িক’। এই দুঃসময় কেটে গেলে আবার সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কাঁটাতারের ওপারে সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের যে অভিযোগ উঠেছে, তাও ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলেই দাবি করছেন শহরে আসা মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁরা মনে করেন, সে দেশে যা ঘটছে, তা ‘রাজনৈতিক বিষয়’। সে সব নিয়ে ভাবার চেয়ে তাঁরা বরং মনে করাতে চাইলেন, দু’দেশের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের কথা। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন মহল মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদানও অস্বীকার করেছে। যদিও তা মানছেন না মুক্তিযোদ্ধারা। ভারতীয় সেনার পাশাপাশি কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গেরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল বলে মানছেন তাঁরা। বাংলাদেশের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বললেন, ‘‘ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের অবদান ভোলার নয়। সেই সময়ে অনেক বাংলাদেশিকে এ রাজ্যের মানুষ আশ্রয় দিয়েছিলেন। ভারতীয় সেনাও সব রকম ভাবে আমাদের সাহায্য করেছিল। তার পর থেকেই দু’দেশের বন্ধুত্ব সুদৃঢ় হয়।’’ এ দেশের বাসিন্দাদের বাংলাদেশে ঘুরে আসার আমন্ত্রণও জানান তিনি। বাংলাদেশ থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গির কবীর সেখানে বর্তমানে ঘটে চলা নানা ঘটনাকে গোটা দেশের ছবি হিসাবে দেখতে নারাজ। সে সব ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলেই তাঁর দাবি। তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সর্বত্র সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতন হচ্ছে, এমনটা নয়। এ সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই মনে হয়। আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা কখনও কোনও দেশের সামগ্রিক ছবি হতে পারে না। যাঁরা হিন্দু বা মুসলিমদের আক্রমণ করছেন, তাঁরা আসলে কোনও সমাজেরই প্রতিনিধি নন।’’ মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে ঐক্যের কথা শোনা গেলেও বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপরে চলা নির্যাতন বা ভারত-বিদ্বেষ নিয়ে তাঁরা বিশেষ কিছু না বলায় অবাক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনাকর্তারাও। তাঁদের মতে, যাঁরা ভারত বিরোধিতা করছেন, তাঁরা হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানেন না, অথবা সেটা অস্বীকার করছেন নিজেদের স্বার্থে। রাজ্যপাল যদিও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে গণতন্ত্রের জয় হিসাবেই দেখছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ভারত বা বাংলাদেশ নয়, গণতন্ত্রের জয় হয়েছিল ওই দিন। বাংলাদেশের জয় ছিল জাতীয় সংহতি, আবেগ ও মানবিকতার জয়।’’ উল্লেখ্য, গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পোস্টে ক্ষুব্ধ হয় বাংলাদেশ। এ বিষয়ে সোমবারই ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ‘সীমিত’, তাঁর বক্তব্যের নির্যাস এমনই। পড়শি বাংলাদেশের দিকে সবসময় বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ভারত। বিজয় দিবস নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর টুইটকে কটাক্ষ করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনার অবদানকে নস্যাৎ করে দিয়ে আসিফ জানান, মোদির এমন পোস্টের তীব্র বিরোধিতা করছেন তিনি। ফেসবুকে আসিফ লেখেন, ‘তীব্র প্রতিবাদ করছি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছিল বাংলাদেশের বিজয়ের দিন। ভারত ছিল এই বিজয়ের মিত্র, এর বেশি কিছু নয়।’ উল্লেখ্য, ছাত্র আন্দোলনের নেতা হাসনাতের বক্তব্যেও ভারতকে তুচ্ছ করার এই সুরই ছিল। তাঁর দাবি, মুক্তিযুদ্ধ ছিল স্বাধীনতা চেয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সংগ্রাম। সেই যুদ্ধের কৃতিত্ব চেয়ে ভারত ‘হুমকি’ দিচ্ছে বাংলাদেশকে। যদিও তাঁরা যখন সেই মন্তব্য করেছেন, তার কিছুক্ষণ আগেই বিজয় দিবস নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস যে ভাষণ দেন, তাতে সৌজন্যতার খাতিরে একবারও ভারতের নাম নেয়নি। এমনকী বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের নামও নেননি ইউনুস। বেশিরভাগ সময়টা নিজের সরকারের ঢাক পেটাতে এবং শেখ হাসিনার মুণ্ডপাত করতে খরচ করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। যদিও ভারতের হাত ধরেই স্বাধীনতা এসেছিল। কিন্তু বিজয় দিবসে ভারতের জন্য একটাও শব্দ খরচ করলেন না বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস।
গত বছর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের নতুন রসায়ন খুবই মধুর হতে শুরু করেছে। প্রায় ৫০...
Read more
Discussion about this post