এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত তিন ব্যক্তির মধ্যে অন্যতম হলেন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি ছাড়াও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহা্ম্মদ ইউনূস এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সেনাপ্রধানের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎকারের পর এখন তিনিও আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছেন। আর সবচেয়ে বেশি চর্চা হচ্ছে যে বিষয়ে, সেটা হল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে খালেদা জিয়ার ৪৩ মিনিটের বৈঠক নিয়ে। সকলের কৌতুহল, কি এমন আলোচনা হল দুজনের মধ্যে! তাহলে কি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নতুন কোনও পদক্ষেপ হতে পারে? বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন কোনও মোড় নিতে পারে?
বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান সম্পর্কে এই মধ্যে দুটি ধারণা তৈরি হয়েছে সে দেশের জনমানসে। এক দল মনে করছেন, তিনি জামায়তে ইসলামী, হিজবুত তেহরির মতো স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিগুলিকে প্রাধান্য দিতে চাইছেন। তাঁদের হাত শক্ত করছেন এবং এই শক্তিগুলিকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় আনার চেষ্টা করে চলেছেন। আর আরেক দল মনে করছেন, সেনাপ্রধান সরাসরি ভারতের তাবেদারি করছেন এবং আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় আছেন। এই সেনাপ্রধানের বিভিন্ন কার্যকলাপ ও বয়ান বিশ্লেষন করে এই দুটি মতের সৃষ্টি। যা নিয়ে একেক দল নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিচ্ছেন নিজেদের যুক্তি। কিন্তু এই আবহেই সেনাপ্রধান আচমকা পৌঁছে গেলেন খালেদা জিয়ার বাসভবন ঢাকার গুলশানের ফিরোজায়। তিনি সেখানেই দীর্ঘদিন অসুস্থতার জন্য গৃহবন্দি। দুই বছরের বেশি সময় কারাবন্দি থাকার পর খালেদা জিয়া গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন মুক্তি পান। সর্বশেষ ২১ নভেম্বর ঢাকায় সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার সেই বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবনে গিয়েই সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান। তবে তাঁদের মধ্যে কোন কোন বিষয়ে কথা হয়, তা নিয়ে মুখে কুলুপ দুই পক্ষেরই। যদিও এটাকে সৌজন্য সাক্ষাৎ বলে এড়িয়ে গিয়েছে দুই পক্ষ। তবে জল্পনা-কল্পনা থামেনি এর পর।
বাংলাদেশ আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ অধিদফতর আইএসপিআর সেনাপ্রধানের খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে কোনও বিবৃতি না দেওয়ায় জল্পনা আরও বেড়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, বাংলাদেশের তদারকি সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বায়কের বিষয়ে সেনা প্রধান যথেষ্ট বিরক্ত, তিনি তাঁদের একেবারেই পছন্দ করছেন না। আবার এই ছাত্রনেতারা যে নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি করে নির্বাচনে যাওয়ার তাল করছেন, সেটাও মেনে নিতে পারছেন না সেনাপ্রধান। অনেকেই মনে করছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যে রাজনৈতিক দল গঠনের ইঙ্গিত, তার জন্যই মুহাম্মদ ইউনূসের নির্বাচন নিয়ে গড়িমসির কারণ। এটাই সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জমানের অপছন্দের অন্যতম কারণ। এই পরিস্থিতিতে তিনি ফের আসরে নামছেন বলেই মনে করছে অভিজ্ঞ মহলের একাংশ। ফলে অসুস্থ খালেদা জিয়াকে দেখতে যাওয়ার আছিলায় তিনি আসন্ন নির্বাচন নিয়ে রূপরেখা তৈরি করলেন না, এর কোনও গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না। এই মুহূর্তে বিএনপি নেতারাও এই ছাত্র সমন্বায়কদের কার্যকলাপে বিরক্ত। বিএনপিও নির্বাচনের ডেডলাইন এগিয়ে আনতে তদারকি সরকারকে চাপ দিচ্ছে।
সেনাপ্রধানও দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে। ফলে দুই পক্ষ এক আসনে আলোচনা করলে নির্বাচন প্রসঙ্গ উঠবেই তা একটি শিশুও বলে দিতে পারে। জানা যাচ্ছে, খালেদা জিয়া এবং সেনাপ্রধানের মধ্যে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ফজলে এলাহি আকবর এবং সেনাপ্রধানের স্ত্রী সারাহনাজ কমলিকা জামান। যিনি আবার শেখ হাসিনার তুতো বোন। কিন্তু ওই বৈঠকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে খালেদা-পূত্র তারেক রহমান বা বিএনপির অন্যান্য শীর্ষনেতারা উপস্থিত ছিলেন না এটাও কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারছেন না। প্রসঙ্গত, গত ডিসেম্বরের শুরুতে ভারতের বিদেশসচিব বিক্রম মিশ্রি ঢাকা সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে বিদেশসচিব পর্যায়ে বৈঠকের পাশাপাশি তিনি আলাদা করে সাক্ষাৎ করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে। জানা যাচ্ছে, ওই দিন নির্ধারিত না থাকা সত্বেও বিক্রম মিশ্রি দেখা করেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা হয়েছিল। যদিও এই বৈঠক সৌজন্য বলা হলেও তাতে কোন কোন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তা খোলসা করা হয়নি। ফলে অনেকে মনে করছেন, বিক্রম মিশ্রি ভারতের তরফে কিছু বার্তা বাংলাদেশের সেনাপ্রধানকে পৌঁছে দিয়েছেন।
সম্প্রতি, সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ভারত সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলেছেন। যা নিয়ে অসন্তোষ দানা বেঁধেছে ছাত্রনেতাদের মধ্যে। মনে করা হচ্ছে, বিক্রম মিশ্রির মাধ্যমে ভারত কিছু বিশেষ বার্তা সেনাপ্রধানের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। যেগুলি এখন তিনি প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন। খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতেও সেই বার্তা নিয়ে আলোচনা করে থাকতে পারেন সেনাপ্রধান। কারণ, ভারতও চাইছে বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন করিয়ে একটা স্থায়ী সরকার আনতে। তাহলে ভারতের সঙ্গে সমস্ত চুক্তি এবং সাক্ষরিত মৌ-গুলির সঠিক রূপায়ন করা সম্ভব। বর্তমান তদারকি সরকার ভারতের সঙ্গে চুক্তিগুলি রূপায়নে বাঁধা দিচ্ছে এবং ভারতের প্রকল্পগুলি আটকে দিতে চাইছে। যা ভারতের জন্য প্রভুত ক্ষতি। ফলে আগামী কয়েকদিনে বাংলাদেশে নতুন কোনও ঘটনা ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
Discussion about this post