শফিকুল আলম, তিনি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। অর্থাৎ সরকারি আমলা। সেই সফিকুল প্রায় প্রতিদিনই নিয়ম করে সাংবাদিক সম্মেলন করেন এবং সরকারের থেকে বেশি রাজনৈতিক কথা বলেন। এবার তিনি একটি ফেসবুক পোস্ট করলেন। সেখানে সুইজারল্যান্ডের কোনও এক রেলস্টেশনে তোলা তাঁর নিজের কয়েকটি ছবি শেয়ার করে লিখলেন, “পালিয়ে সুইজারল্যান্ড এসেছি!! তোমরা যার যার অবস্থান থেকে পালাও। আপা ইজ ব্যাক। সাথে দি এ টিম ও নাহিদ রেইনস”। সোশ্যাল মিডিয়ায় শফিকুল আলমের এ হেন পোস্ট ঘিরে শোরগোল পড়ে যায়। সত্যিই কি তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়েছেন? সত্যিই কি শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছেন? এমনও সব হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তবে উত্তর হল তিনি মোটেই কোথাও যাননি, বরং বহাল তবিয়তে ঢাকায় অবস্থান করছেন। কিন্তু তিনি ফেসবুকে যে পোস্টটি দিয়েছেন, সেটার গুরুত্ব ও তাৎপর্য কিন্তু সুদূরপ্রসারী।
অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির অন্যতম দুই মুখ হাসনাত আবদুল্লাহ এবং আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও ফেসবুকে পোস্ট শেয়ার করেছেন। সবগুলো পোস্টেরই বিষয়বস্তু এক, কিন্তু প্রকাশ ভিন্ন। আসল বিষয় হল বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তনের পটভূমি তৈরির চেষ্টা এবং শেখ হাসিনাকে নিরাপদে দেশে ফেরানোর পরিকল্পনা। আর এই দুটি কাজই শুরু করেছেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান। যেটা বিভিন্ন আকারে ইঙ্গিতে অনুমান করতে হচ্ছিল, এখন সেটা পরিস্কার করে দিলেন শফিকুল, হাসনাত ও আসিফ মাহমুদরা। আমরা জানি, দুই দিন আগেই সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান আচমকা দেখা করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে। যাদের মধ্যে দীর্ঘ সাড়ে চার মাস মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল, কথাবার্তা বন্ধ ছিল, আচমকা কি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে সোজা যমুনায় গিয়ে ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করলেন সেনাপ্রধান। সেই সঙ্গে কৌতুহল তৈরি হয়েছিল, কে কাকে তলব করেছেন সেটা নিয়েও।
আবার তাঁদের মধ্যে ঠিক কোন কোন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, সেটা নিয়েও কৌতুহল কম নয় বাংলাদেশে। এখন সেই আলোচনার আঁচ খানিকটা পাওয়া যাচ্ছে। একদিকে ভারতের প্রবল চাপ অন্যদিকে সেনাপ্রধান ওয়াকারের অনাস্থা, সবমিলিয়ে চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সেই সঙ্গে তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে তাঁর কাছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও তাঁর কাছে নির্দেশ এসেছে দ্রুত জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও মদতদাতাদের দমন করতে। যতদুর জানা যাচ্ছে ঈদের পরের এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করতে পারেন। যার মধ্যে এই হাসনাত আবদুল্লহা, আসিফ মাহমুদদের নামও রয়েছে। এবার হাসনাত তীব্র আক্রমণ করলেন সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামানকে। শুধু আক্রমণ নয়, তাঁরা গুরুতর অভিযোগ তুললেন তাঁর বিরুদ্ধে। সেনাপ্রধান নাকি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছেন। এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে ডেকে বৈঠক করে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করার প্রস্তাবও দিয়েছেন। ডাকা হয়েছিল জাতীয় নাগরিক পার্টিকেও। হাসনাতের ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যাচ্ছে, গত ১১ মার্চ তাঁদের ডাকা হয়েছিল। কিন্তু সেনাপ্রধানের প্রস্তাব তাঁরা সরাসরি নাকচ করে এসেছেন। কিন্তু এতদিন পর কেন হাসনাত মুখ খুললেন, সেটা নিয়েই উঠছে প্রশ্ন।
এবার আসি অন্য কথায়, সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামানের উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা ঠিক কি। এই প্রসঙ্গে একটা ফেসবুক পোস্টের উল্লেথ করা প্রয়োজন। আল জাজিরা টিভির এক সাংবাদিক, যিনি অনেকটাই বিপ্লবী ছাত্রদের সমর্থক। তিনি গত ১০ মার্চ একটি ফেসবুক পোস্ট করেছিলেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেছিলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের অন্দরেই বেশ কয়েকজন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর এজেন্ট রয়েছেন। এমনকি বাংলাদেশের উপদেষ্টা, সচিব পর্যায়ের আধিকারিক, সামরিকবাহিনীর শীর্ষ কর্তাদের মধ্যেও ভারতীয় গুপ্তচর রয়েছেন। জুলকারমাইন সায়ের নামের ওই সাংবাদিক দাবি করেছেন, এমন শীর্ষ আধিকারের সংখ্যা ৯ জন। যারা সরকারের সমস্ত গোপন আলোচনা, তথ্য ও সিদ্ধান্ত ফাঁস করে চলেছেন। এবং র-এর নির্দেশে তাঁরা ভিতর ভিতর শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের মঞ্চ তৈরি করে চলেছেন। তিনি ৯ জন ছাড়াও আরও পাঁচ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার এতে যুক্ত থাকার দাবি করেছেন। তবে তিনি কারও নাম উল্লেথ করেননি।
অন্যদিকে আমরা যদি সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামানের পূর্ববর্তী বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও মন্তব্যের কথা স্মরণ করি, তাহলে দেখবো সেনাপ্রধান বরাবরই বলে এসেছেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া কোনও উপায় নেই। একমাত্র ভারতই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারে। আবার ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদীও সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। ফলে দুয়ে দুয়ে চার করলেই বোঝা যাবে। শেখ হাসিনা এই মুহূর্তে ভারতের রাষ্ট্রীয় অতিথি। তাঁকে বাংলাদেশে স্বমহিমায় ফেরত পাঠাতে যে উদ্যোগী হবেন নরেন্দ্র মোদি এটা বলাই বাহুল্য। কারণ, মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদ ও খিলাফত আন্দোলনের আঁতুড়ঘরে পরিণত করেছেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর পরামর্শ মতোই যে সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান তাঁর যাবতীয় পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন, সেটা শফিকুল, হাসনাতদের ফেসবুক পোস্ট থেকেই স্পষ্ট।
Discussion about this post