বাংলাদেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে লাগোয়া একটি গ্রাম বড়াইবাড়ি। ২০০১ সালে ১৮ই এপ্রিল গ্রামে ঘটে ইতিহাস সাক্ষী করা একটি ঘটনা। একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৬ জন সেনা নিহত হন। এমনকি তখন বাংলাদেশের বিডিআর এর ২ জন সৈনিক নিহত হন। বরাইবাড়ি গ্রামে সীমান্তের অপরপ্রান্তে ভারতের আসাম রাজ্য। জানা যায়, ১৮ই এপ্রিল ভোরে বড়াইবাড়ির কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা তাদের কৃষিজমিতে যান। তখন তারা দেখতে পান, ধানক্ষেতের মধ্যে প্রচুর সশস্ত্রবাহিনী। তারা বাসিন্দাদের দেখতে পেয়ে, সৈন্য বাহিনী বাসিন্দাদের কাছে জানতে চান, বিডিয়ারের ক্যাম্প কোথায়? যদিও তখন গ্রামবাসীরা বুঝতে পারেন, এর আসলে ভারতের বিএসএফের সদস্য। বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতীয় সেনারা ঢুকেছে। এই খবরটি খুব দ্রুত বরাইবাড়ি মিডিয়া ক্যাম্পে পৌঁছে দেন সাইফুল ইসলাম লাল। জানা যায়, তিনি নিজে একজন আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তিনি যখন বিডিআর ক্যাম্পে যান তখন নাকি ওই ক্যাম্পে ৮ জন বিডিআর সদস্য ছিলেন। তিনি সেখানে গিয়ে বলেন, বিএসএফ আমাদের এলাকায় ঢুকে পড়েছে। তখন বিডিআর সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। পরে তিনি বাইরে এসে দেখেন বিএসফ সদস্যদের। তিনি তৎক্ষণাৎ ভিতরে গিয়ে খবর দেন। শুরু হয় গোলাগুলি। তিনি নিজেও হাতে অস্ত্র তুলে নিলেন। সেই ঘটনায় কেঁপে ওঠে বরাইবাড়ি। বহু গ্রামবাসী গ্রাম ছাড়া হয়ে যান। এই ঘটনাটি খুব কাছ থেকে দেছিলেন রুহুল আমিন। ২০১৪ সালে এলাকার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন রুহুন আমিন।
শোনা যায়, যেদিন বিএসএফ বড়াইবাড়ি আক্রমণ করে, সেদিন নাকি স্থানীয় মানুষজনকে সংগঠিত করার কাজ করেছিলেন রুহুল। বিএসএফকে প্রতিরোধ করার জন্য১২জন সদস্যকে জড়ো করেন রুহুল আমিন। তিনি বলেন, বিএসএফ যখন বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকে তখন অনেক গ্রামবাসী পালিয়ে যায়। তারপরে আবার ফিরেও আসে। এরপর তারা বিডিআরের সঙ্গে একসঙ্গে মিলে বিএসএফের বিরুদ্ধে লড়ে।
ভোর ৫টা থেকে ১১টা পর্যন্ত বড়াইবাড়ি গ্রামে বিভীষিকা মুহূর্ত ছিল। দুপক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়।
বড়াইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্পের ভেতরে থাকা সাইফুল ইসলাম লাল ক্যাম্প থেকে দেখেন , আনুমানিক কয়েকশ বিএসএফ সদস্য বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করেছিল। বড়াইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্পের ৮জন সদস্য খুব সাহস নিয়ে প্রথম চারঘন্টা লড়াই চালিয়ে গেছেন।
এরই মধ্যে আশপাশের আরও দুটি বিডিআর ক্যাম্প থেকে প্রায় ২০জন সদস্য বড়াইবাড়িতে আসেন। তারা প্রত্যেকেই প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। বড়াইবাড়িতে যখন তীব্র সংঘর্ষ চলে, তখন ঢাকায় তৎকালীন বিডিআর সদর দফতরের নির্দেশনায় জামালপুর এবং ময়মনসিংহ থেকে বহু বিডিআর সদস্য পাঠানো হয় বড়াইবাড়িতে। তারা আনুমানিক সকাল সাড়ে দশটায় পৌঁছন। আগের দিন ভোর ৫ টা থেকে পরের দিন সকাল ১১ টা পর্যন্ত গুলি বর্ষণ হয়। খানিক বিরতি থাকলেও ফের শুরু হয়। ১৮ই এপ্রিল সারাদিন চলে। এদিকে ১৯শে এপ্রিল রাত পর্যন্ত গোলাগুলি দেখা যায়। বড়াইবাড়ি সংঘাতে ১৬জন বিএসএফ সদস্যের মৃতদেহ পাওয়া যায় বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে কেন রৌমারী আক্রমণ করে বিএসএফ?
জানা যায়, এই ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল সিলেটের পদুয়াতে। সেখানে বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে ভারতের বিএসএফ একটি ক্যাম্প করে দীর্ঘদিন সে জায়গা দখল করে আছে। সিলেটের পদুয়াতে বিএসএফের সেই ক্যাম্পতিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কোনও রকম উত্তেজনা ছিল না।
২০০১ সালে জানা যায়, প্রথমে ভারতের বিএসএফ পাশের একটি ক্যাম্পের সঙ্গে সংযোগ সড়ক নির্মাণ শুরু করে বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতর দিয়ে। এই রাস্তা নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশের বিডিআর আপত্তি তোলে। শুরু হয় ঝামেলা। ভারতের বিএসএফ নাকি কোনও কর্ণপাত করেনি। তাদের কাজ তারা করতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে বিডিআরের সেই এলাকায় একটি অস্থায়ী অপারেশনাল ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা পদুয়াতে যায় এবং সেখানে ৩খানা ক্যাম্প স্থাপন করে। বিএসএফ সেখানে ৬টি গুলি চালায়। শুধু তাই নয়, তারা প্রায় ৭০ জনের মতো সারেন্ডার করে।এমনকি তখন পদুয়া দখল হয়ে যায়। জানা যায়, পদুয়ার ঘটনার জেরে কুড়িগ্রাম সীমান্তের বড়ইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্প দখলের জন্য বিএসএফ বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকে।
এই ঘটনার পর একটি ছবি সংবাদমাধ্যমে দেখা যায়। সেখানে গুলিতে নিহত একজন ভারতীয় সৈন্যেকে হাত-পা বেঁধে বাঁশের সঙ্গে ঝুলিয়ে গ্রামবাসী কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে। এই ছবি ভারতের কাছে একটি ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। যেটা ভারত বাংলাদেশের সম্পর্কে ভবিষ্যতেও তাড়িয়ে বেড়াবে। এই ঘটনায় বিডিয়ার এর ভূমিকাকে সাহসী বলে বর্ণনা করা হয়। আবার কেউ কেউ অন্য ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। এমনকি ফজরুল রহমানের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলা হয়। অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে বিপদে ফেলার জন্যই এই ঘটনা। যদিও তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। 2001 সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তার অবসরের কথা ঘোষণা করা হয়। পরে তিনি বলেন, আমাকে ঘটনার জন্য দোষারোপ করা হলেও তার কোনও ভিত্তি নেই।
Discussion about this post