উপলক্ষ্য ছিল ওয়াকফ আইনের বিরোধিতা। কিন্তু মুর্শিদাবাদে যা হল সেটা তার থেকেও বড় কিছু। যেখানে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে, সেখানে রাজ্যের শাসকদল ব্যাস্ত ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করতে। ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি, ভারতের স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত যা করে আসছে দেশে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। ভোট ব্যাংকের রাজনীতির জন্য ভারতের প্রতিটি প্রদেশেই এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলের উৎপত্তি, প্রভাব ও প্রতিপত্তি বেড়েছে। ঠিক যেমন পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস। ৩৪ বছরের বাম আমলে রাজ্যের আর্থিক হাল অত্যন্ত বেহাল বলেই দাবি করেছিল তৃণমূল।
সেই সঙ্গে রাজ্যের আকাশছোঁয়া বিকাশ বা উন্নয়নের স্বপ্ন ফেরি করে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। সিঙ্গুরের টাটা সংস্থার ন্যানো গাড়ির কারখানা উৎখাত করে যে সরকার ক্ষমতায় আসে তারা যে কতটা উন্নয়নমুখী সেটা আর বলে বোঝানোর দরকার নেই। রাজ্যে শিল্প, কল-কারখানা নাই আসুক, ভোট ব্যাংকের রাজনীতির জেরে লক্ষীর ভান্ডার থেকে কন্যাশ্রী, রুপশ্রী যুবশ্রী বিভিন্ন দানধ্যানমূলক প্রকল্প চালু রেখেছে তৃণমূল। যা তাদের পরপর তিনবার ক্ষমতায় আজকে সাহায্য করেছে। তৃণমূল হোক বা বামফ্রন্ট অথবা কংগ্রেস বরাবরই সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতি করেই আসছে। ফলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যখন ওয়াকফ সংশোধনী আইন পাশ করালো তখন দেশজুড়ে এর প্রতিবাদে সামিল হয়ে গেল বিরোধী সবকটি দল।
এই রাজ্যে তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলেন পশ্চিমবঙ্গের ওয়াকফ আইন লাগু হবে না। অর্থাৎ লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাস হওয়া ল অফ দা ল্যান্ড তিনি অস্বীকার করলেন। এর ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনের মনের জোর আরও বেড়ে গেল। কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি, জেলায় জেলায় চলল বিক্ষোভ প্রতিবাদ। রাজ্যের মন্ত্রী শিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীও প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে রাখলেন কলকাতাকে অবরুদ্ধ করে দেওয়ার। ফলে যা হওয়ার তাই হল। মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেল হিংসা ছড়িয়ে পড়তে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ওই জেলায় সংখ্যালঘুদের অধিক্য বেশি। তাই সহজেই উস্কানি দিয়ে মানুষজন খেপিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা ও রাজ্যের গোয়েন্দা বিভাগের ব্যর্থতা।
রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ মনে করছেন, যখন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা এজেন্সিগুলি মুর্শিদাবাদের হিংসায় বাংলাদেশী দুষ্কৃতিদের হাত সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছে, তখন রাজ্য সরকার তা অস্বীকার করছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং দাবি করলেন, এর পিছনে বিএসএফ দায়ী।
আবার মুর্শিদাবাদে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে তিনি কংগ্রেসকেও কাঠগড়ায় তুলছেন। তাঁর দাবি, যেখানে গণ্ডগোল হয়েছে, সেটা মুর্শিদাবাদের লোকসভা আসনের আওতায় নয়, মালদহ লোকসভা আসনের অধীনে। ওটা কংগ্রেসের জেতা আসন।” কংগ্রেসকে আক্রমণ করে তিনি আরও বলেন, জেতার সময় জিতবে, আর দাঙ্গা হলে রাস্তায় বেরবে না, এটা আশা করি না। কিছু ঘটলে জন প্রতিনিধিদের সঙ্গে থাকতে হবে।”
অপরদিকে কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীও মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করতে ছাড়েননি। তিনি বলেন, ভোট-রাজনীতি করতে গিয়ে শুভ-অশুভের পার্থক্যই ভুলে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আমরা চাই, তাঁর শুভবুদ্ধির উদয় হোক।”
রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের মতে, পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে ৩০ শতাংশের বেশি মুসলিম ভোট রয়েছে। আর এই ভোটের সিংহভাগ তৃণমূলের দখলে। সামান্য কিছু অংশের ভোট পায় বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস। সংখ্যালঘু ঘটে ছিটেফোঁটাও আসে না বিজেপির ঝুলিতে। ফলে ভোট ব্যাংকের খেলাটা ঠিক এখানেই। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় ৩০ শতাংশ ভোট তৃণমূলের তাহলে আর ১০-১৫ শতাংশ হিন্দু ভোট জোটাতে পারলেই ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যে বিজেপির ভোট প্রায় ৪০ শতাংশ। তাহলে অংকটা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, প্রায় ৭০% ভোট তৃণমূল ও বিজেপি ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। বাকি ৩০ শতাংশের মধ্যে যে বেশি ভোট পাবে তার হাতে ক্ষমতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুবিধা মুসলিম ভোট তিনি একতরফা ভাবে নিজের পকেটে রাখতে পারছেন। তাই ভোটব্যাংকের রাজনীতি তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাতে যদি দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় তাও সই।
Discussion about this post