এবারের লোকসভা ভোটে রাজ্যের দুই প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূল এবং বিজেপি তাঁদের কয়েকজন বিধায়ককে প্রার্থী করেছিল। যাদের কেউ কেউ জিতেছেন, কেউ হেরেছেন। এই জয় পরাজয়ের তালিকা মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে ওই বিধানসভা আসনগুলির মধ্যে দশটি আসনে উপনির্বাচন অবশ্যম্ভাবী। জয়ীদের ক্ষেত্রে লোকসভার সদস্য হিসেবে শপথ নিতে হলে বিধায়ক পদে ইস্তফা দিতে হবে। অপরদিকে তিন বিজেপি বিধায়ক দল বদলে তৃণমূলের টিকিটে লোকসভা ভোটে লড়েছে। তাঁদেরও ইস্তফা দিতে হয়েছে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন মেনে। সূত্রের খবর, জলদি এই দশটা বিধানসভা এবং আগে থেকে খালি থাকা মানিকতলা বিধানসভায় উপনির্বাচনের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। ফলে ওই বিধানসভায় প্রার্থীপদ নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে তৎপরতা।
বঙ্গ রাজনীতিতে একটা শব্দ বহুল প্রচলিত, সেটা হল ‘বিজেমূল’। এই শব্দটির উৎস বিজেপি এবং তৃণমূলে আসাযাওয়া নেতাদের মাধ্যমে। আসলে বঙ্গ বিজেপির মূল সাপ্লাই লাইন হল তৃণমূল। বিগত বছরগুলিতে তৃণমূল থেকে অসংখ্য নেতা যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। আবার এদের মধ্যে অনেকেই সুবিধা করতে না পেরে ফিরেছেন সেই তৃণমূলে। যেমন শুভেন্দু অধিকারী, মুকুল রায়, অর্জুন সিং, সৌমিত্র খাঁ, তাপস রায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। অপরদিকে বিশ্বজিৎ দাস, কৃষ্ণ কল্যাণী, মুকুটমণি অধিকারী যারা বিজেপি হয়ে আবারোও ফিরেছেন তৃণমূল শিবিরে। এখন বঙ্গ রাজনীতিতে একটাই চর্চা, যে দশ আসনে উপনির্বাচন হতে চলেছে, সেখানে কারা কারা প্রার্থী হতে পারেন।
২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২ আসনের ফলাফলে একটা বিষয় পরিস্কার, যারা দল বদল করেছিলেন তাঁরা এবার জিততে পারেননি। অর্থাৎ, এই বিজেমূলীদের জনতা পছন্দ করেনি। যেমন, ব্যারাকপুরের অর্জুন সিং. রানাঘাটের মুকুটমণি অধিকারী, বনগাঁর বিশ্বজিৎ দাস, কলকাতা উত্তরের তাপস রায় এবং বরাহনগর বিধানসভা উপনির্বাচনে সজল ঘোষের মতো প্রার্থীরা এবার হেরেছেন। এখন তাঁরা রাজনতৈতিকভাবে কোনঠাসা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত। কয়েকটি সূত্র মারফৎ জানা যাচ্ছে, এই দলবদলুদের কয়েকজন নতুন করে তৃমমূলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন, যাতে বিধানসভার টিকিট পাওয়া যায়।
ব্যারাকপুরের বাহুবলী নেতা অর্জুন সিং, তিনি সেই ১৯৯৯ সাল থেকে পুরসভা, বিধানসভা এবং লোকসভা ভোটে হারেননি। সেই অর্জুনই এবার ধরাশায়ী হয়েছেন পার্থ ভৌমিকের কাছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এবার অর্জুনের দায়বদ্ধতা নিয়েই প্রশ্নচিহ্ন উঠেছিল ব্যারাকপুরবাসীদের মধ্যে। ১৯-এর লোকসভার আগে তিনি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যান, এবং বিজেপির টিকিটে জিতে সাংসদ হন। কিন্তু ২০২২ সালেই তিনি ফের তৃণমূলে ফেরেন। দুই বছরের মধ্যেই লোকসভার টিকিট না পেয়ে ফের বিজেপিতে যোগ দিয়ে ব্যারাকপুর আসনে প্রার্থী হন। তাঁর এই বারবার দলবদল একেবারেই ভালো চোখে দেখেননি ভোটাররা। ফলে তৃণমূলের পার্থ ভৌমিকের কাছে পরাজিত হয়ে তিনি কোনঠাসা। জানা যাচ্ছে, অর্জুন ফের তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছেন। উল্লেখ্য, নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিক ইস্তফা দিলে সেখানে উপনির্বাচন হবে।
এবারের লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায় যোগ দেন বিজেপিতে। তিনি কলকাতা উত্তর কেন্দ্রে প্রার্থীও হন। কিন্তু তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পরাজিত হন। অপরদিকে তাঁর ছেড়ে আসা বিধানসভায় উপনির্বাচনে জিতেছে তৃণমূল প্রার্থী সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে এখন কার্যতই কোনঠাসা তাপস রায়। সূত্রের খবর, তাঁর এক ‘বন্ধু’র মারফৎ নতুন করে যোগাযোগ শুরু করেছেন পুরোনো দলে ফেরার জন্য।
অপরদিকে, রায়গঞ্জের বিজেপি বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যাণী, রানাঘাট দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক মুকুটমণি অধিকারী এবং বাগদার বিজেপি বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস এবার তৃণমূলের টিকিটে লোকসভায় প্রার্থী হয়ে হেরেছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই বিধায়ক পদে ইস্তফা দিয়েই লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। ফলে একদিকে যেমন তাঁরা সাংসদ হতে ব্যর্থ, তেমনই তাঁরা এখন আর বিধায়ক নন। ফলে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রবল আতঙ্কিত এই ‘বিজেমূলী’ সর্বহারা নেতারা এখন শাসকদলের দাক্ষিণ্যের দিকে তাঁকিয়ে।
Discussion about this post