সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনের জেরে তোলপাড় আওয়ামি লিগ পরিচালিত বাংলাদেশ। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলিগের দফায় দফায় সংঘর্ষ । মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে শতাধিক। এই পরিস্থিতিতে ভারতের কোটা ব্যবস্থা আদৌ কি যুক্তিযুক্ত কিনা সেই নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
সরকারি চাকরিতে কেন সংরক্ষণ? সংরক্ষণের কারণে বঞ্চিত হচ্ছেন যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা। বৈষম্য বিলোপ করতে সংরক্ষণ একপ্রকার বৈষম্যেরই নামান্তর। ভোগান্তি বাড়ছে সংরক্ষণের বাইরে থাকা লাখো লাখো চাকরিপ্রার্থী। আর সেই কারণে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ চাইছে সরকারি চাকরি থেকে সব রকমের সংরক্ষণ বিলোপ হোক। বাংলাদেশে এই সংরক্ষণ প্রথা চালু মুক্তি যুদ্ধের পর। ১৯৭২ সাল থেকে। মুক্তি যোদ্ধাদের অবদানের কথা স্মরণে রেখে তাঁরা, তাঁদের পরিবার ও সন্তান-সন্ততিদের জন্য সংরক্ষণ চালু হয়। এছাড়া সংরক্ষণের সুবিধা পায় মহিলা, পিছিয়ে পড়া জনজাতি। এছাড়া বিভিন্ন জেলার জন্যও সংরক্ষণ বরাদ্দ থাকে। এইভাবে সরকারি চাকরির মোট ৫৬ শতাংশই চলে গিয়েছে সংরক্ষণের কোটায়। বাকি ৪৪ শতাংশ আসনে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হয়।
তবে বাংলাদেশে এই সংরক্ষণের পরিস্থিতিটা আরও ভয়াবহ ছিল। একটা সময় ১০০ শতাংশের মধ্যে ৮০ শতাংশই চলে যেত কোটার খাতায়। মাত্র ২০ শতাংশ আসনে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হোত। এটা ছিল ১৯৭২ সালের ঘটনা। এই ৮০ শতাংশ আসন ছিল জেলার জন্য বরাদ্দ। যেখানে ৩০ শতাংশ বরাদ্দ ছিল মুক্তি যোদ্ধাদের জন্য। ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাদের জন্য। চারবছর পর ১৯৭৬ সালে সংরক্ষণ ব্যবস্থায় কিছুটা বদল করা হয়। তাতে বলা হয় মোট নিয়োগের ৪০ শতাংশ হবে মেধার ভিত্তিতে। বাকি ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারী এবং ১০ শতাংশ নিয়োগ জেলার বাসিন্দাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়। এরপর আরও বেশ কয়েকবার কোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের পর বর্তমানে কোটার আওতায় সংরক্ষণের পরিমাণ ৫৬ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
সংরক্ষণের জেরে দেশের বড় একটা অংশ যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আন্দোলন প্রথম বড় আকার নেয় ২০১৮ সালে। আন্দোলনের চাপে পড়ে সংসদে দাঁড়িয়ে সব ধরনের সংরক্ষণ বাতিলের কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাখা হয় শুধু জনজাতিদের ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের ১ শতাংশ সংরক্ষণ। সংরক্ষণ বাতিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে যায় কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আদালত তাঁদের পক্ষে রায় দেয়। আবার আগের মতো সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু হয়ে যায় বাংলাদেশে। সংরক্ষণ নিয়ে চাপে থাকা হাসিনা সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। এরই মাঝে দেশ জুড়ে ফের ২০১৮ সালের মত সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। বলাবাহুল্য দেশের শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি, বেসরকারি চাকরিতে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সংরক্ষণ নিয়ে চাপা ক্ষোভ ক্রমশই প্রকাশ্যে আসছে। তারই ফলশ্রুতি বাংলাদেশে সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন।
এখন প্রশ্ন ভারতের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে পড়া দেশ বাংলাদেশ। তা সত্ত্বেও ভারতে সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন জোরাল নয় কেন। সংরক্ষণ বিরোধিতার কথা বলা হলেও তা কখনোই কড়া অবস্থান নেয় না। কেন? প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ সংরক্ষণ বিরোধিতায় জেগে উঠলেও আমাদের দেশ ভারত নয় কেন? শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে আসন সংরক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন দেখা গিয়েছে ভারতের বিভিন্ন অংশে। কোটার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ছাত্ররা বিক্ষোভও দেখিয়েছেন। দেশের প্রেক্ষাপটে সংরক্ষণকে যদি একটি রোগ হিসেবে ধরা হয় তাহলে বলতে হবে এই রোগের উৎপত্তি বহু বছর আগে। সেই ব্রিটিশ আমলে। সেই সময় গোটা সমাজ জুড়ে ছিল ব্রাহ্মণদের ব্যাপক আধিপত্য। অনগ্রসর শ্রেণি তো বটেই অব্রাহ্মণদেরও ব্যাপকভাবে ব্রাহ্মণদের হাতে পর্যুদস্ত হতে হোত। প্রাক স্বাধীনতা থেকে সংরক্ষণ চালু হলেও বর্তমান ভারতের আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে পড়েছে চাকরি ও শিক্ষায় কোটা ব্যবস্থা। সংবিধানের ১৫(৪) ও ১৬(৪) ধারায় বলা ছিল যে, সংরক্ষণের সীমা কখনোই ৫০ শতাংশ ছাড়াবে না। পরে তা সংশোধিত হয়। সেই সংশোধন অনুযায়ী, যে কোন রাজ্য সরকার অনগ্রসর শ্রেণির সামাজিক অগ্রগতির কথা ভেবে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে পারে। এ বিষয়ে সুপ্রিম নির্দেশও রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেও বলা হয়েছে, কোনও রাজ্য চাইলে ৫০ শতাংশের বেশি সংরক্ষণ দিতে পারে। তবে সংরক্ষণ বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখা থাকতে হবে। যেমন ভারতের তামিলনাডুতে ৬৯ শতাংশ, তেলেঙ্গনায় ৬২ শতাংশ এবং মহারাষ্ট্রে চাকরির ক্ষেত্রে অনগ্রসর শ্রেণির প্রার্থীদের জন্য ৫২ শতাংশ কোটা আছে। তামিলনাড়ুর সর্বশেষ প্যানেল সমীক্ষা অনুযায়ী রাজ্যটির মোট জনসংখ্যার ৪৫.৫% শতাংশ ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস ও ২৩.৬% শতাংশ সর্বাধিক অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ। অভিযোগ এর মধ্যে, কয়েকটি রাজ্যে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির আওতায় মুসলিমদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
এই রাজ্যের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গও রয়েছে। কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে একশ্রেণির ভারতীয় নাগরিকদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে ব্যস্ত রাজনীতিক কারবারিরা। আখেরে লাভ দুপক্ষেরই। সম্প্রতি ২০১০ সালের পর ৫ লাখ ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিলের নির্দেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। উচ্চ আদালত সাফ জানিয়ে দেয় ওবিসি ওয়েস্ট বেঙ্গল ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস কমিশন অ্যাক্ট ১৯৯৩’ অনুযায়ী নতুন তালিকা তৈরি করতে হবে। তারপর সেই তালিকা বিধানসভায় পেশ করে চূড়ান্ত অনুমোদন নিতে হবে। ২০১০-এর আগে ওবিসি শ্রেণিভুক্ত গোষ্ঠীগুলি বৈধ থাকবে, এমনই নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় তৃণমূল কংগ্রেসে আসার পরেই ওবিসি সার্টিফিকেট ইস্যু করার বিষয়ে দুর্নীতি করার অভিযোগ ওঠে। অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও প্রচুর মানুষকে ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় বলে দাবি করে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করা হয়। তবে ভারতের রাজনীতির সঙ্গে কোটা ব্যবস্থা এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছে আগামীদিনে তা লোপ করা যাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
Discussion about this post