তিনি যেমন স্বপ্ন দেখেছিলেন, তেমনই স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এই অভাগা রাজ্যে শিল্প-টিল্পের তেমন জায়গা নেই। তাই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল তাঁর। তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। বামজমানায় রাজ্যের সবচেয়ে বেশি সময়ের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ডেপুটি ছিলেন। তার আগে ছিলেন রাজ্যের তথ্য এবং সংস্কৃতি দফতরের মন্ত্রী। একবার জ্যোতি বসু নতুন টাউন হলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বুদ্ধদেবকে দেখিয়ে বলেছিলেন, “এই যে আমাদের বুদ্ধদেব। ও বেশ শিল্প-টিল্প নিয়ে আছে। সিনেমা, নাটক, গান, সাহিত্য এসবই ওঁর পছন্দ। শুনেছি, ওঁর বাসায় নাকি পা রাখার জায়গা নেই। চারধারে শুধু বই আর বই”। বর্ষীয়ান জ্যোতি বসু হয়তো বুঝেছিলেন, এই বুদ্ধদেবই একদিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হবেন, আর পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের জোয়ার আনার স্বপ্ন দেখবেন। তাই পরবর্তী সময় তাঁকে বনিকসভার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন সঙ্গে করে।
বাম আমলের দীর্ঘসূত্রিতায়, পশ্চিমবঙ্গের শিল্প চেহারা দমবন্ধ হয়ে আসা পাখির মতো হয়ে গিয়েছিল। হাওড়া, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের মতো এলাকাগুলি রীতিমতো ধুঁকছে। তাই নিজের আজীবন লালিত ভাবমূর্তি বাজি রেখেই মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঝাঁপিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের শিল্প ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে। তিনি বুঝেছিলেন, বড় বড় শিল্প না এলে এ রাজ্যের ছোট ও মাঝারি শিল্প হালে পানি পাবে না। তাই ২০০৬ বিধানসভা নির্বাচনে যখন বামফ্রন্ট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এল তখন তিনি শিল্পায়নের অভিমুখে রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিলেন। সেবার শপথ নিয়েই তিনি টাটাদের এক লাখি গাড়ি ন্যানো তৈরির কারখানার খবর জানিয়ে দিলেন। হুগলির সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো গাড়ির কারখানা তৈরির প্রস্তাব হয়। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই ধা্ক্কা খায় সেই স্বপ্ন। সিঙ্গুরের জমি পরিদর্শনে গিয়ে গ্রামবাসীদের অবরোধ-বিক্ষোভের মুখে পড়েন টাটা এবং রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিরা। যদিও শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অন্যন্য বিরোধী দলের প্রতিরোধের মুখে পড়ে টাটা গোষ্ঠী সিঙ্গুর ত্যাগ করে। ফলে জোড়াল ধাক্কা খেল বুদ্ধবাবুর শিল্প আনার প্রচেষ্টা। একই পরিস্থিতি তৈরি হয় নন্দীগ্রামে।
সেখানে কেমিক্যাল হাব তৈরি পরিকল্পনা নিয়েছিল বুদ্ধবাবুর সরকার। কিন্তু সেখানেও বাধা আসে গ্রামবাসীদের থেকে। আরও এক কদম এগিয়ে নন্দীগ্রামে ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ বিরোধী গ্রামবাসীদের উপর গুলি চালায় বুদ্ধদেবের পুলিশ। তাতে নিহত হয় ১৪ জন। আর এরপরই চিরতরে বিলিন হয়ে যায় বুদ্ধদেবের শিল্পের স্বপ্ন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পরবর্তী সময়ে শুধুই বিতর্ক সঙ্গী ছিল বুদ্ধদেবের। এমনকি সেই সময় অনেকে পুলিশ প্রশাসনে বুদ্ধদেবের রাশ আলগা হয়ে গিয়েছিল বলে দাবি করেছিলেন। ফলে যা হওয়ার হল। ২০০৬ সালে যে বামফ্রন্ট একতরফা সাফল্য পেয়েছিল, সেই বামফ্রন্ট ২০০৮ সালে পঞ্জায়েত ভোট এবং ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটে ব্যাপক ধাক্কা খায় বামফ্রন্ট। আর ২০১১ সালে তো বাংলা দেখল পালাবদল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রীত্বে ইতি টেনে দিলেন বিধাতা। আর সেই সঙ্গে বাংলার শিল্পায়নের স্বপ্নও শেষ হয়ে গেল। একসয়ম পশ্চিমবঙ্গকে দেশের শিল্প মানচিত্রে উজ্জ্বল অক্ষরে দেখানোর জন্য যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন বাম জমানার শেষ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সেটিই তাঁর ব্যর্থতার মূল কারণ হয়ে দাঁড়াল।
Discussion about this post