বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বহু আলোচিত মানবিক করিডোর নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কার্যত কড়া ভাষায় হুঁশিয়ারি দিলেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান। ফলে আতঙ্কে পিছু হঠলেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ডঃ খলিলুর রহমান। বুধবার এক সাংবাদিক সম্মেলন করে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তথা রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ডঃ খলিলুর রহমান। আরও একবার ১৮০ ডিগ্রি পাল্টি খেয়ে তিনি বললেন, মানবিক চ্যানেল আমরা দেবো কী দেবো না এটা আমাদের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত। মানবিক চ্যানেল নিয়ে আমেরিকা বা চিন কারও থেকেই বাংলাদেশের ওপর কোনও চাপ নেই। তিনি জোরের সঙ্গেই বলার চেষ্টা করেছেন, এটা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করাও হবে না।
রাখাইন মানবিক করিডোর নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অবস্থআন রাতারাতি কিভাবে পাল্টে গেল? সূত্রের খবর, ২০ মে রাতে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবন যমুনায় এক বিশেষ বৈঠক হয়। উচ্চপর্যায়ের এই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। পাশাপাশি ওই বৈঠকে ডাকা হয়েছিল বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল হাসান মাহমুদ খানকেও। বিবৃতিতে ওই বৈঠকের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে হওয়ার কথা বলা হলেও জানা যাচ্ছে, সেখানে মূলত রাখাইন মানবিক করিডোর নিয়েই আলোচনা হয়েছে। আসলে সেনাপ্রধান এবং সেনাবাহিনীর অধিকাংশ শীর্ষ আধিকারিকই চাইছেন না, রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়ার নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক ঘাঁটি অথবা লজিস্টিক হাব তৈরির অনুমতি দেওয়া হোক। প্রথম থেকেই এই বিষয়ে আপত্তি তুলে আসছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান। কিন্তু বাংলাদেশ সেনার একটা অংশ আবার মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি অনুগত্য দেখিয়ে রাখাইন করিডোর নিয়ে অতি উৎসাহী ছিল। সেই অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন লেফটানান্ট জেনারেল কামরুল হাসান এবং ফইজুর রহমানের মতো সেনা আধিকারিকরা। কিন্তু যমুনায় গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে তিন বাহিনীর প্রধানই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কার্যত হুঁশিয়ারির সুরেই বলে এসেছেন, কোনও করিডোর দেওয়া যাবে না।
অন্যদিকে, জেনারেল ওয়াকার উজ জামান বুধবার ক্যান্টনমেন্টের দরবার হলে সেনা আধিকারিকদের উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। সূত্রের খবর, তিনি ওই ভাষণেও স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ওই প্রস্তাব তারা মানবে না। এমনকি ওই করিডরকে ‘রক্তাক্ত করিডর’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন তিনি। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, এবার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পাশাপাশি আরও কয়েকটি ইস্যুতে ইউনূস সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সেনাপ্রধান। যেমন, তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। এবং কেবলমাত্র একটি নির্বাচিত সরকারই জাতির গতিপথ নির্ধারণ করবে, একটি অনির্বাচিত প্রশাসন নয়। পাশাপাশি ওই ভাষণে সেনাপ্রধান বলেন, সেনাবাহিনী আর জনগণের হিংসা বা আইনহীনতা সহ্য করবে না। কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা হবে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশ সেনার এই হুঁশিয়ারি ইউনূস প্রশাসনের ওপর যথেষ্টই চাপ তৈরি করবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যাচ্ছে, মূলত চারটি বিষয়ে জোর দিয়েছেন সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান। প্রথমটি হল, রাখাইন মানবিক করিডোর দেওয়ার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। বিশেষ করে অস্বাভাবিকভাবে কঠোর ভাষা ব্যবহার করে খলিলুর রহমানের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। জেনারেল ওয়াকার স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “কোনও রক্তাক্ত করিডোর ব্যবসা হবে না”। দ্বিতীয়টি হল, তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে “ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে”। এবং কেবলমাত্র নির্বাচিত সরকার দেশের গতিপথ নির্ধারণ করবে, এমন প্রশাসন নয় যা জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে না। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামরুল হাসানের সঙ্গে সেনাপ্রধানের বিরোধিতা এখন প্রকাশ্যে। ফলে এই মন্তব্য, কামরুল হাসানদেরও চাপে ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। তৃতীয়টি হল, জেনারেল ওয়াকার উজ জামান একটি জোরালো বার্তা পাঠিয়েছেন যে “সেনাবাহিনী আর গণ-সহিংসতা বা অনাচার সহ্য করবে না” যা গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ জুড়ে হয়ে চলেছে। প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের আগস্টে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের দ্বারা অপরাধ এবং ভয় দেখিয়ে লুটপাট, ধর্ষণের ঘটনা বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে। এবার তার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করবে বাংলাদেশ সেনা। চতুর্থ বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। সেটি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কমান্ডিং অফিসার জানিয়েছেন, “১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার এবং জাতীয় মর্যাদার সঙ্গে কোনও আপস করা যাবে না এবং কোনও পরিস্থিতিতেই এর সঙ্গে আপস করা উচিত নয়। অর্থাৎ, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা বা তাঁদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার কেড়ে নেওয়ার মতো বিষয়গুলি সেনাবাহিনী বিরোধিতা করছে। এ ব্যাপারে গোটা বাহিনী সেনাপ্রধানের পাশেই দাঁড়াচ্ছে। সূত্রের খবর, এদিন ঢাকা সেনানিবাসের দরবার হলে উপস্থিত ৯০০ থেকে ১,২০০ জন সেনা অফিসাররা সেনাপ্রধানকে জানান যে “অফিসার্স কোর” জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ এবং “আদেশ মেনে কাজ করতে প্রস্তুত”। সবমিলিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের যে বিদায় ঘণ্টা বেজে গেল সেটা বলাই বাহুল্য।
Discussion about this post