গত বছর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের নতুন রসায়ন খুবই মধুর হতে শুরু করেছে। প্রায় ৫০ বছর পর পাকিস্তানের সঙ্গে সমুদ্রপথে বাণিজ্য শুরু করেছে দুই দেশ। এবার আকাশপথেও সরাসরি যোগাযোগ অর্থাৎ সরাসরি বিমান পরিসেবা চালু মুখে। এই আবহেই দীর্ঘ ১৫ বছর পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়ে গেল ঢাকায়। গত ১৭ এপ্রিল ঢাকায় এসেছিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালোচ। তিনি বৈঠক করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মোহম্মদ জসীম উদ্দিনের সঙ্গে। পাশাপাশি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালোচ সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে। কূটনৈতিক মহলের মতে, এই মাখামাখি সম্পর্কের মধ্যেও একটা কাঁটা থেকে গিয়েছে। সেটা হল পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের মোট ৪.৫২ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক দাবি নিয়ে। অপরদিকে দেড় দশক পর সচিব পর্যায়ের বৈঠকে পাকিস্তানকে আরও একটি বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ। যা এই সম্পর্কের সমীকরণ বদলে দিতে পারে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। সেটা হল ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ককে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করতে হলে অতীতের অমীমাংসিত বিষয়গুলি সমাধানের প্রস্তাব। সবমিলিয়ে পাক পররাষ্ট্র সচিবের এবারের ঢাকা সফর কতটা সফল হল আর কতটা বৈরিতা তৈরি হল সেটা নিয়ে কাঁটাছেড়া হবে, এটা বলাই বাহুল্য।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মোহম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, একাত্তরে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বলেছে বাংলাদেশ। এছাড়া স্বাধীনতা-পূর্ব সম্পদ হিসেবে ৪২০ কোটি ডলার ফেরত চেয়েছে ঢাকা। এ নিয়ে ইসলামাবাদ আলোচনায় রাজি হয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্র সচিব। প্রসঙ্গত, ১৯৭০ সালে ভোলায় ঘূর্ণিঝড়ের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পাঠানো ২০০ মিলিয়ন ডলারের বিদেশী রাষ্ট্রের আর্থিক সাহায্য গায়েব করেছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। অভিযোগ, স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তানের ঢাকা শাখায় জমা হওয়া এই অর্থ মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই ব্যাংকের লাহোর শাখায় স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। এ ছাড়া সেই সময় পশ্চিম পাকিস্তানে নিযুক্ত অনেক বাংলাদেশি সরকারি কর্মচারী স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এলেও তাদের জমা হওয়া ভবিষ্যৎ তহবিল ও সঞ্চয়পত্র পাকিস্তান কখনই ফেরত দেয়নি। সবমিলিয়ে পাকিস্তানের কাছে মোট ৪.৫২ বিলিয়ন ডলার দাবি করে বসে ঢাকা। যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মোহম্মদ জসীম উদ্দিনের দাবি, এ নিয়ে ইসলামাবাদ আলোচনায় রাজি হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে চাইলেই কি পাকিস্তান বাংলাদেশের দাবি মানবে? ইতিহাস বলছে অন্য কথা। পাকিস্তান আজ পর্যন্ত কোনও বিষয়েই ক্ষমা চাইনি। ভারতের সঙ্গে কার্গিল যুদ্ধের কারণ নেই হোক বা মুম্বই হামলার ঘটনা নিয়েই হোক। আর টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে তো পাকিস্তানের দুর্নাম গোটা বিশ্বজুড়েই। চিন হোক বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট, সৌদি আরব হোক বা বিশ্ব ব্যাংক, পাকিস্তানের টাকা ফেরত দেওয়ার রেকর্ড খুবই খারাপ। হলে বাংলাদেশ যতই দাবি করুক, যতই তথ্য প্রমাণ দিক, পাকিস্তান যে বাংলাদেশকে এক টাকাও দেবে না সেটা হলফ করেই বলা যায়। যদিও পাকিস্তান বরাবরই ভারতের শত্রুভাবাপন্ন দেশদের একটু বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এই মুহূর্তে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক একেবারেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। তাই বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের দরদ এতটা বেড়েছে। আসলে পাকিস্তান চাইছে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি পুষিয়ে নিতে। কারণ, বাংলাদেশ আমদানি করে বেশি, রফতানি করে কম। পাশাপাশি, ভারত সম্প্রতি বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করেছে। এখানে পাকিস্তান চাইছে তাঁদের বন্দর ব্যবহার করুক বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশ সেখানে, ৭১-এর ঘটনার অমীমাংশিত বিষয়গুলি মীমাংসা করতে চাইছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে চাইছে ৭০- ৭১-এর পাক সেনার কীর্তিকলাপের জন্য পাকিস্তান যেন ক্ষমা চায়। আবার পাকিস্তানের থেকে পাওনা প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার যেন ফেরত দেয় ইসলামবাদ। কিন্তু কার্যত ভিখারি পাকিস্তান সেটা দিতে পারবে বলে মনে করছেন না বহু কূটনৈতিক।
Discussion about this post