দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়ে গেল। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে উচ্চপর্যায়ের এই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন মুহাম্মদ ইউনূস। পাশাপাশি ওই বৈঠকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল হাসান মাহমুদ খান-সহ কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আচমকা এই বৈঠক নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন। বিশেক করে দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে ডাকা হয়নি বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিচালক বা আইজিকেই। পাশাপাশি এই বৈঠকে ডাকা হয়নি প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদাবক্স চৌধুরী, যিনি প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার এবং দেশের আইন শৃঙ্খলার বিষয়টি দেখাশোনা করেন। কেন তাঁদের ডাকা হল না? যা নিয়ে তৈরি হয়েছে রহস্য।
প্রশ্ন আরও আছে, যেমন গত বছর ৫ আগষ্টের পর অন্তরবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। একটি হল, আইন শৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে এই কমিটি গঠন করা হয়েছিল, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে এই কমিটিতে আরও এগারো জন উপদেষ্টা রয়েছেন। এই কমিটি নিয়মিত বৈঠক করে দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে থাকে। এই কমিটির বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা উপস্থিত থাকেন না।
আর দ্বিতীয় কমিটি হল, নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। এই কমিটির সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা স্বয়ং। এটি আরও উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এই কমিটিতে সাতজন উপদেষ্টা সহ প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি এবং ক্যাবিনেট সচিব অন্যতম সদস্য হিসেবে থাকেন। পাশাপাশি নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটিতে তিন বাহিনীর প্রধান সহ আরো চারজন বিশেষ সদস্য সচিব রয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয় হল ২০ মে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় যে বিশেষ বৈঠকটি হল তাতে অন্য কোন কমিটি সদস্যদের ডাকাই হল না কিন্তু যার থাকার কথা নয় তাকেই গুরুত্ব দিয়ে বৈঠকে হাজির করানো হল। তিনি হলেন সদ্য নিযুক্ত বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ডঃ খলিলুর রহমান। তাহলে কি অন্য কোন বিষয় নিয়ে এই জরুরি বৈঠক?
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় হল মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে মানবিক করিডোর দেওয়া। যে করিডর বাংলাদেশ ভূখণ্ড দিয়ে রাখাইন প্রদেশে যাবে মূলত মিয়ানমারের বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি ও অন্যান্য গোষ্ঠীগুলিকে সহায়তা প্রদান করার জন্য। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দাবি করছে রাষ্ট্রপুঞ্জ এই মানবিক করিডর তৈরি করতে চাইছে। যার মাধ্যমে মূলত খাদ্য বস্ত্র ও ওষুধপত্রের মত মানবিক সহায়তা পাঠানো হবে , রাখাইন ও তার আশেপাশের প্রদেশে। কিন্তু আসল বিষয়টি হল, রাষ্ট্রপুঞ্জের আড়ালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই রাখাইন করিডোর করে আরাকান আর্মিকে অস্ত্র ও প্রয়োজনীয় গোলাবারদ সরবরাহ করতে চাইছে বলেই ওয়াকিবহাল মহলের মত। আর এই করিডরের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চট্টগ্রামের কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপে নিজেদের বেস স্টেশন তৈরি করতে চায়। অর্থাৎ একটি সামরিক ঘাটতি তৈরি করতে চাইছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যা তাদের দীর্ঘ কয়েক দশকের ইচ্ছা ছিল। বাংলাদেশের পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে তাদের ঘাটি তৈরি করতে দিতে অস্বীকার করেন। যার জেরে তার বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্ত এবং অবশেষে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে তাকে। মার্কিন ডিপ স্টেটের কাঠপুতুল মুহাম্মদ ইউনুস মার্কিন প্রবাসী কূটনৈতিক ডাক্তার খলিলুর রহমানকে ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই মানবিক করিডর দেওয়ার নামে একটি সামরিক ঘাঁটি তৈরি করার অনুমতি দিতে চাইছেন। যা নিয়ে ঘোরতর আপত্তি বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামানের। ফলে মুহাম্মদ ইউনূসের সামনে একমাত্র কাটা জেনারেল ওয়াকার। তাকে বোঝানোর বহু চেষ্টা হয়েছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভিতর আড়াআড়ি বিভক্ত করে অথবা খলিলুর রহমানকে সেনাবাহিনীর বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে সেনাপ্রধানের খর্ব করার চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু কোন কিছুতেই দমানো যায়নি জেনারেল ওয়াকার উজ জামানকে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ২০ মে বাংলাদেশ সেনার তিন প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে মূলত রাখাইন মানবিক কলিজার নিয়েই আলোচনা হয়েছে। অপরদিকে এও জানা যাচ্ছে, ২১ মে সেনাপ্রধান দরবার হলে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করতে চলেছেন। সেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিকদের সামরিক পোশাকেই আসতে বলা হয়েছে। তিনি কিছু ঘোষণা করতে পারেন। এখন দেখার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি বা রাখাইন অডিডর নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস ও জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের মধ্যে দ্বন্দ্ব কোন পর্যায়ে পৌঁছয়।
Discussion about this post