ভারতবর্ষে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব। সেই সময় যানবাহন বলতে ছিল পালকি আর ঘোড়ায় টানা গাড়ি। তবে সাধারণ মানুষের জন্য যাতায়াতের কোন ব্যবস্থা ছিল না একমাত্র জান বলতে ১১ চাকা অর্থাৎ নিজের ডান পা এবং বাঁ পা । সেই সময় ভারত উপমহাদেশে প্রথম ট্রাম চালু করা হয় ১৮৭৩ সালে। প্রথম ট্রামের যাত্রাপথ ছিল আর্মেনিয়া ঘাট থেকে শিয়ালদা পর্যন্ত যার দূরত্ব ৩.৯ কিলোমিটার রাস্তা। বর্তমান সময়ে যে ট্রাম আপনারা দেখতে পাচ্ছেন সেই সময় ট্রামের এর ছবি ছিল অন্য। প্রথম যখন ট্রাম নামানো হয় তৎকালীন ভারতের রাজধানীতে, সেই সময় ঘোড়ায় টানা এক কামরার ট্রাম চলত। যদিও পরবর্তীতে এই ট্রাম চলাচল বন্ধ হয়ে যায় যাত্রীর অভাবে। পুনরায় লন্ডনের “ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি” কলকাতায় আবারো ট্রাম পরিষেবা শুরু করে শুধু তাই নয় এর সাথে সাথে আরো কিছু নতুন রুট চালু করা হয়। প্রায় ১৭৭ টি ট্রাম যা ১০০০ টি ঘোড়া দ্বারা চালানো হতো। ট্রামের গতি বাড়াতে পরবর্তীতে স্টিম ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় এবং যুক্ত হয় দুই কামরার ট্রাম এবং ট্রামের মোট রেল পথ ছিল সেই সময় ২৮ কিলোমিটার। এবং প্রথম খিদিরপুরে ট্রাম ডিপো করা হয়। এরপর ১৯০২ সালে প্রযুক্তিতকে ব্যবহার করে শুরু হয় বৈদ্যুতিক ট্রাম, এবং ট্রাম সংখ্যা বাড়িয়ে নতুন করে রাজাবাজার ও টলিগঞ্জে কলকাতার সব থেকে বড় ট্রাম ডিপো তৈরি করা হয়। প্রথম দিকে ট্রাম চলাচলের পথ ছিল সাতটি।
১, শ্যামবাজার থেকে সেন্ট্রালএভিনিউ হাওড়া সেতু
২, হাওড়া সেতু থেকে কলেজ স্ট্রিট হয়ে শিয়ালদা
৩, কলেজ স্ট্রিট থেকে বিধাননগর
৪, শ্যামবাজার থেকে কলেজ স্ট্রিট হয়ে এসপ্ল্যানেড
৫, এসপ্ল্যানেড থেকে পার্ক সার্কাস সেভেন পয়েন্ট হয়ে গড়িয়াহাট
৬, বালিগঞ্জ থেকে রাসবিহারী ক্রসিং হয়ে টলিগঞ্জ
৭, এসপ্ল্যানেড থেকে ময়দান হয়ে খিদিরপুর
যার মধ্যে বর্তমানে কেবলমাত্র এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর এবং গড়িয়াহাট থেকে এসপ্ল্যানেড যুক্ত হয়ে শ্যামবাজার এই দুটি লাইন চলছে। তবে কলকাতা বাসির অথবা বলা চলে পশ্চিমবঙ্গের জন্য অত্যন্ত দুঃখের সংবাদ, গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য চঞ্চলাচল এখন বন্ধ। কেবল ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য শুধুমাত্র একটি রুটের অর্ধেক পথ যাত্রা করবে এই ট্রাম। এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর যাওয়ার রাস্তায় এই ট্রাম্প যাতায়াত করবে। তবে পুরোপুরি নয়, এসপ্ল্যানেড ট্রাম ডিপো থেকে ময়দান পর্যন্ত এই গ্রাম চলাচল করবে কেবল পর্যটকদের জন্য। এখনও কলকাতার সাধারণ মানুষের গন্তব্যে পৌঁছানোর ভরসা ট্রাম, ভিড় ঠেলে মেট্রো ও বাসকে দূরে রেখে ধীর গতির এই যাত্রা অনেক মানুষের প্রিয়। তবে অতিরিক্ত গতির দৌড়ে পিছিয়ে থাকো ট্রাম, অবশেষে যাতায়াতের জন্য পিচ রাস্তার লাইনে আর চাকা ঘষবে না, যানবাহনের ভিড়ে শোনা যাবে না ঢং ঢং শব্দ। অন্যান্য দেশে ট্রাম আরো উন্নত করে তুলেছে, নতুনরূপে সাজিয়েছে ট্রাম গুলিকে সেই দৌড়ে পিছিয়ে পড়লো পশ্চিমবঙ্গ, রাজ্যের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারলেন না সরকার। হাত ছেড়ে দিলেন ট্রামের। ট্রামের পরিবহন কর্মীদের পুরোপুরি কর্ম-বিরতি।
আর হয়তো সিনেমায় দেখতে পারবো না ট্রামের ব্যবহার, আবারও হয়তো কেউ তার গানে লিখবে না “চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন আর কবিতার সুরে কাপ প্লেট” গানে কাপ প্লেট থাকলেও আর দেখা মিলবে না ট্রামের। পথের পাঁচালীতে যেমন দুর্গা ও অপু এক ছুটে চলে যেত ট্রেন দেখতে, ঠিক সেই ভাবেই কলকাতার বিভিন্ন অলিগলি থেকে সেই ঢং ঢং শব্দ শুনলেই দৌড়ে ট্রাম দেখতে আসতো কলকাতার অনেক অপু- দুর্গারা। ট্রাম থেকে যাবে কেবল সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের পুরনো সিনেমায়। বিদায় বেলায় মিলিয়ে যাবে বিরহ সুরের ট্রামের সেই ঢং ঢং।
Discussion about this post