২০১৪ এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে একাই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল ভারতীয় জনতা পার্টি। সেই সাফল্য ছাপিয়ে এবার আরও বড় রেকর্ড গড়তে উঠেপড়ে লেগেছিল বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে বিজেপির সমস্ত ছোট-বড় নেতা এবার স্লোগান তুলেছিলেন “আব কি বার চারশো পার”। অর্থাৎ, এবার বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ৪০০ আসন পার করবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি ছিটিয়েছে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট। এনডিএ জোট ৩০০ আসনই পার করতে পারেনি, আর বিজেপি পায়নি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু সাফল্যের ফানুস ওড়ানো বিজেপি কেন এবার মুখ থুবড়ে পড়ল? যা নিয়ে সাড়া দেশে চলছে নানান জল্পনা-কল্পনা।
বিজেপির খারাপ ফলের প্রসঙ্গে উঠে আসছে গত ১০ বছরের বিজেপির কি কি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা পুরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে তাঁরা। এছাড়া, রাম মন্দির ইস্যু, ধর্মীয় মেরুকরণ কোনও কিছুই এবার কাজে এল না বিজেপির। এবার যে এতটা খারাপ ফল হবে, সেটা বোধহয় কল্পনাতেও আনেননি বিজেপির শীর্ষনেতৃত্ব। অথচ সেটাই সত্যি হল। আসলে এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে সবচেয়ে বেশি ধোঁকা দিয়েছে উত্তরপ্রদেশ। দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় রাজনীতিতে একটা প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে, সেটা হল উত্তরপ্রদেশ যার, দিল্লির মসনদ তাঁর। এই রাজ্যই ভারতকে সবচেয়ে বেশি প্রধানমন্ত্রী দিয়েছে। এমনকি নরেন্দ্র মোদিও গুজরাট ছেড়ে উত্তরপ্রদেশের বারানসী আসন থেকে ভোটে লড়ছেন। উত্তরপ্রদেশ বরাবরই জাতপাতের রাজনীতিতে এগিয়ে। এখানে দলিত, সংখ্যালঘু, অনগ্রসর শ্রেণির মানুষরাই ভোটব্যাঙ্ক।
বিগত দুই লোকসভা নির্বাচনে দলিত এবং অনগ্রসর শ্রেণির ভোট নিজেদের বাক্সে টেনেছিল বিজেপি। মূলত সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মারফৎ এই ভোট একত্রিত করেছিল বিজেপি। এবার উত্তরপ্রদেশে ইন্ডিয়া জোট পাল্টা প্রচারে সেটাই করেছে। বহুজন সমাজবাদী পার্টি দিনে দিনে হীনবল হয়ে পড়াও একটা কারণ। অপরদিকে অখিলেশ যাদব এবার শুধুমাত্র যাদব ভোটের পিছনে না গিয়ে আসন ভিত্তিক প্রার্থী দিয়েছিলেন। সেই কারণেই এবার ভালো ফল অর্জন করেছে সমাজবাদী পার্টি। অন্যদিকে রাহুল গান্ধিও নমনীয় মনোভাব নিয়ে ইন্ডিয়া জোটকে অগ্রাধীকার দিয়েছেন। ইন্ডিয়া জোট উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পঞ্জাব, হরিয়না, রাজস্থানের মতো গোবলয়ের রাজ্যগুলির জনগণকে বোঝাতে পেরেছিল, বিজেপি ৪০০ আসন পেলেই সংবিধান পরিবর্তন করে দেবে। এমনকি সংরক্ষণ প্রথাও তুলে দিতে পারে। এটাই কাজে লেগেছে।
আরেকটি কারণ হিসেবে উঠে আসছে অগ্নিবীর প্রকল্পের বুমেরাং হওয়া। অগ্নিবীর প্রকল্পে সেনাবাহিনীতে স্থায়ী চাকরির বদলে চার বছরের চুক্তিভিত্তিক চাকরির ব্যবস্থা চালু করেছিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। ফলে লক্ষ লক্ষ তরুণ এতে ক্ষিপ্ত হয়েছিল। অগ্নিবীর প্রকল্প নিয়ে সাড়া দেশেই বিক্ষোভ হয়। তবে সেই বিক্ষোভের সবচেয়ে বেশি অভিঘাত ছিল উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পঞ্জাব এবং হরিয়ানায়। আর দেখা যাচ্ছে, এই রাজ্যগুলিতেই বিজেপি খারাপ ফল করেছে। ইন্ডিয়া জোট প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাঁরা ক্ষমতায় এলে অগ্নিবীর প্রকল্প তুলে দিয়ে সেনাবাহিনীতে স্থায়ী নিয়োগ করা হবে। এটাও একটা কারণ, ইন্ডিয়া জোটের ভালো ফল করার।
তিন নম্বর কারণ হিসেবে যেটা উঠে আসছে সেটা হল কৃষক অসন্তোষ। লোকসভা ভোটের আগেই উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব, হরিয়ানা, দি্ল্লি এনসিআর অঞ্চলের কৃষকরা তীব্র আন্দোলন শুরু করেছিল। এই কৃষক আন্দোলনকে লাগাতার সমর্থন করে গিয়েছিলেন রাহুল গান্ধি। পাশাপাশি ইন্ডিয়া জোটের তরফে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা ক্ষমতায় এলে কৃষিপণ্যের সহায়ক মূল্য বা এমএসপি-কে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হবে। কংগ্রেস তাঁদের ইস্তেহারেও এটা লিখেছে। বিজেপি যেটা দেয়নি। ফলে কৃষক আন্দোলনের জেরেও জোরালো ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি। অপরদিকে, বিজেপি এবার ভেবেছিল, পশ্চিমবঙ্গ থেকে এবার ২৭-২৮টি আসন আসবে। ফলে গো-বলয়ে কিছু আসন হারালেও তা পুষিয়ে যাবে। কিন্তু এই রাজ্যে বিজেপি আটকে গিয়েছে মাত্র ১২ আসনে। ফলে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা যেমন পায়নি, তেমনই এনডিএ জোটের শরিকদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। যেটাও ইন্ডিয়া জোটের একটা সাফল্য হিসেবে ধরা হচ্ছে।
Discussion about this post