নব্বইয়ের দশকে ভারতে সবচেয়ে সস্তা এবং আকর্ষণীয় মোবাইল পরিষেবা দিত এয়ারসেল। সেই সময় ভারতে টেলিকম ব্যবসা করা এয়ারটেল, টাটা ডোকোমো, ভোডাফোন, আইডিয়া কেউই এয়ারসেলের মতো পরিষেবা দিতে পারতো না। গ্রাহক সংখ্যাতেও সকলকে টেক্কা দিত এয়ারসেল। সেই সংস্থাই ২০১৮ সালে এসে দেউলিয়া হয়ে যায়। কিন্তু কেন এই অধঃপতন? জিও আসাতেই কি ব্যবসা গোটাতে হয় এয়ারসেলকে? জানুন আসল গল্প।
১৯৯০ সালে কংগ্রেস সরকার উদার অর্থনীতির জেরে ভারতে মোবাইল ফোনের বাজারে জোয়ার আসে। সরকারি টেলিকম সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি টেলিকম সংস্থাকেও ভারতে ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হয়। ফলে নতুন নতুন কোম্পানি ভারতে টেলিকম ব্যবসায় অংশগ্রহন করতে শুরু করে। এই সময়ের ফায়দা তুলতে চিন্নাকান্নন শিবাশঙ্করণ চালু করলেন এয়ারসেল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, দেশে যে হারে মোবাইল ফোনের চাহিদা বাড়ছে, তাতে প্রচুর সিমকার্ড বিক্রি হবে। এই সময় টেলিকম সংস্থা খুললে তিনি লাভের মুখ দেখবেন। শুরুটা নিজের রাজ্য তামিলনাড়ু থেকেই করেছিলেন। প্রথমে গোটা তামিলনাড়ুজুড়ে তিনি ফাইবার অপটিকস বসালেন এবং বেস স্টেশন তৈরি করলেন। প্রথম থেকেই শিবশ্ঙ্করণ চাইছিলেন একটা শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করতে। সে কারণে তিনি ফাইবার অপটিকস পাতার কাজে জোর দিয়েছিলেন। এর ফায়দাও তিনি পেয়েছিলেন। এয়ারসেলের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের জেরে গ্রাহকরা দ্রুত ইন্টারনেট এবং স্বচ্ছ কল করার সুবিধা পাচ্ছিলেন। পাঁচ বছরের মধ্যেই তিনি গোটা তামিলনাড়ুতে মোবাইল পরিষেবায় একনম্বরে উঠে আসে এয়ারসেল। এবার শিবশঙ্করণের নজর পড়ে ভারতের বাকি রাজ্যের দিকে।
প্রথমদিকে তাঁর টার্গেট ছিল কম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলি। তাই অসম-সহ উত্তর পূর্ব রাজ্যগুলি, সিকিম, বিহার, ওড়িশা এবং জম্মু-কাশ্মীরে এয়ারসেলের নেটওয়ার্ক তৈরি করলেন। সেই সময় এয়ারসেল বিভিন্ন রাজ্যের স্থানীয় ভাষায় গ্রাহকদের পরিষেবা দিতে শুরু করে। এমনকি দুর্দান্ত সব ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস চালু করেছিল এয়ারসেল। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে এয়ারসেলের ব্যবসা। এয়ারসেল যে রাজ্যে ব্যবসা শুরু করেছিল, সেখানেই তাঁরা দারুণ সাড়া পাচ্ছিল। ভারতে টেলিকম ব্যবসা যত বাড়তে শুরু করে, এয়ারসেলও তত নতুন নতুন প্রযুক্তি এনে গ্রাহকদের তাক লাগিয়ে দিতে থাকে।
সময়টা ২০০৩ সাল, সেই সময় ভারতে শুধুমাত্র ২জি ইন্টারনেট প্রযুক্তি ছিল। সেই সময়ই এয়ারসেল ভারতে নিয়ে জিপিআরএস এবং এজ প্রযুক্তি। যা ইন্টারনেট পরিষেবায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হয় আজও। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই জিপিআরএস বা এজ প্রযুক্তি কি। যারা ২জি ইন্টারনেট ব্যবহার করেছেন, তাঁরা জানেন সেই সময় মোবাইল ফোনে টাওয়ার চিহ্নের পাশে G বা E লেখা থাকতো। এখন বলি, মোবাইলে ইন্টারনেট চালাতে হলে কয়েকটি প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়। যেমন, GPRS, EDGE (এজ), HSDPA, HSPA+, LTE ইত্যাদি। ২জি ইন্টারনেটের জন্য ছিল এই জিপিআরএস এবং এজ প্রযুক্তি। এতে সর্বোচ্চ ইন্টারনেট স্পিড ছিল ৩৮৪ কেবি প্রতি সেকেন্ড। তবে এই প্রযুক্তিতে কাউ ভয়েস কলের সঙ্গে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারতেন না। ফলে সেই সময় মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য ফোন কল কেটে দিতে হতো। কিন্তু এই প্রযুক্তিই ছিল সেই সময়ের সর্বোচ্চ। যা এয়ারসেল প্রথমবার চালু করে গ্রাহকদের মন জয় করে নিয়েছিল। ধীরে ধীরে ভারতে ৩জি এবং ৪জি ইন্টারনেট চালু হল। এয়ারসেল সব ক্ষেত্রেই নতুন নতুন প্রযুক্তি আমদানি করে গ্রাহকদের তাক লাগিয়ে দিতে শুরু করল। এয়ারসেলই প্রথম বেসরকারি সংস্থা যারা ভারতে একসঙ্গে ২জি, ৩জি এবং ৪জি ইন্টারনেট পরিষেবা দিতো।
এয়ারসেলের এই উন্নতি দেখে মালয়েশিয়ার এক বড় সংস্থা ম্যাক্সিস কমিউনিকেশন এয়ারসেলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। তাঁরা এয়ারসেলের ৭৪ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। এতে এয়ারসেলের লাভ হয়েছিল। কারণ, এই চুক্তির ফলে এয়ারসেল আর্থিক দিক থেকে যেমন লাভবান হয়েছিল, তেমনই আরও উন্নত প্রযুক্তিগত সাপোর্ট পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময় এয়ারসেলের মালিক শিবশঙ্করণ দাবি করেছিলেন, তৎকালীন রাজনৈতিক কারবারীদের কাছ থেকে চাপ আসার জন্যই তিনি ম্যাক্সিস কমিউনিকেশনের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অন্যদিকে ২০০৮ সালে যে ২জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি হয়েছিল তাতেও নাম জড়িয়ে যায় এয়ারসেলের। ২০০৯ সালে আদালতের নির্দেশে সিবিআই এই ২জি স্পেকট্রাম মামলার তদন্ত শুরু করে। তদন্তে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ২জি স্পেকট্রাম বন্টনের জন্য কোনও নিলামই হয়নি বলে জানতে পারে সিবিআই। এয়ারসেলও বেআইনিভাবে ২জি স্পেকট্রাম হাতিয়ে নেয়। সেই সময় সুপ্রিম কোর্ট ২জি মামলায় ১২২টি লাইসেন্স বাতিল ঘোষণা করেছিল।
এর জেরে সবচেয়ে সমস্যায় পড়ে যায় এয়ারসেল। কারণ, তাঁদের হাত থেকে যেমন লাইসেন্স চলে যায়, তেমনই টাকা ধ্বংস হয়েছিল। সেই সময় থেকেই এয়ারসেলের পতন শুরু। জানা যায় সেই সময় এয়ারসেলের হাতে ৮৯ মিলিয়ন গ্রাহক এবং ৪০ হাজার টাওয়ার ছিল। এয়ারসেলের হাল এতটাই বেহাল ছিল যে, শিবশঙ্করণ তাঁর সংস্থা বেঁচতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কার্যত দেউলিয়া এয়ারসেল কিনতে কেউ আগ্রহী ছিলেন না। তবে অবশেষে ২০১৬ সালে এগিয়ে আসে রিলায়েন্স কমিউনিকেশন। উল্লেখ্য, সেই সময় রিলায়েন্স ছিল অনিল আম্বানির অধীনে এবং তাঁরাও চরম আর্থিক সমস্যায় ভুগছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হল, এয়ারসেলকে রিলায়েন্স কিনে নেওয়ার পরও ক্ষতির অঙ্ক বাড়তে থাকে। এমনকি এক বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৭ সালে রিলায়েন্স কমিউনিকেশন এয়ারসেলের থেকে চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে যায়। আর ঠিক সেই সময়ই ভারতের টেলিকম বাজারে প্রবেশ করে মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স জিও। ফলে টেলিকম মার্কেটে বেড়ে যায় প্রতিযোগিতা।
টেলিকম ব্যবসায় এসেই জিও যে দামে পরিষেবা দিতে শুরু করে, তাতে অন্যান্য সংস্থাগুলি হালে পানি পেল না। সে সময় যে দামে অন্যান্য সংস্থাগুলি ৩জি পরিষেবা দিত, রিলায়েন্স জিও সে সময় ওই দামে ৪জি পরিষেবা দেওয়া শুরু করে। ফলে জিও-র গ্রাহক সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। এর জেরে এয়ারসেল আর টেলিকম বাজারে টিকে থাকতে পারেনি। এয়ারসেলের মালিক শিবশঙ্করণ দাবি করেছিলেন, তাঁকে ম্যাক্সিস কমিউনিকেশনের কাছে পুরো সংস্থা বিক্রি করে দেওয়ার চাপ দিতে থাকে টেলিকম মন্ত্রক। এতে তাঁর লাভ হতো না। ঠিক এই সময়ই অর্থাৎ ২০১৮ সালে এয়ারসেল সংস্থা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। ইডি প্রায় ৬০০ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। ফলে ভারতের একমাত্র ব্যক্তিগত মালিকানাধিন টেলিকম সংস্থা এয়ারসেল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
Discussion about this post