শুক্রবার আরাকান আর্মি দাবি করে তাঁরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আঞ্চলিক সেনা সদর দফতরের দখল নিয়ে নিয়েছে। যা মিয়ানমারের জুন্টা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটা উল্লেখযোগ্য সাফল্য বলেই দাবি করেছে মিয়ানমারের ওই সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এমনকি তাঁদের যুগ্ম সংগঠন ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সও এই দাবিকে নিজেদের বিজয় বলেই মনে করছে। মিয়ানমারের সামরিক জুন্টা প্রশাসনের কাছে এটা এমন একটা বড় ধাক্কা যখন তাঁরা আলোচনায় বসেছিলেন থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্কক শহরে। সেই আলোচনায় ছিলেন ভারত, বাংলাদেশ, চিন, থাইল্যান্ড ও লাওসের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা। ভারতের তরফে ছিলেন, বিদেশসচিব বিক্রম মিশ্রি এবং বাংলাদেশের তরফে ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। এই বৈঠকে মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি এবং প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এই বৈঠকের পরই মিয়ানমার আরাকান আর্মির তরফে রাখাইন প্রদেশে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা পায়। রাখাইন প্রদেশের অ্যান শহরে জুন্টা প্রশাসনের পশ্চিমী কমান্ডের সদর দখল নেয় আরাকান আর্মি।
এই ঘটনার পর ভারত তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রনধীর জয়সওয়াল বলেন, মিয়ানমারে জুন্টা বাহিনী এবং সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির তীব্র লড়াইয়ের দিকে ভারত তীক্ষ্ম নজর রাখছে। মিয়ানমারে চলা ভারতের উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলিতেও ভারতের নজর রয়েছে।ভারতের মিজোরাম সীমান্ত থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম মায়ানমারের একটি শহর পালেতোয়া। যার সাথে খুব বেশি ভারতীয় পরিচিত নয়। মায়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধে এই পালেতোয়া শহরের দখল নিতে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি সেনাবাহিনীর সঙ্গে তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। অবশেষে এই শহরের দখল যায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে। কালাদান নদীর তীরে এই পালতোয়া শহরের সঙ্গে ভারতের ঘণিষ্ট যোগ রয়েছে। আরাকান আর্মি মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ এবং দক্ষিণ চিন প্রদেশ মিলিয়ে একটি বৃহত্তর স্বাধীন আরাকান রাজ্যের জন্ম দিতে চায়। অপরদিকে, মিয়ানমারে ভারতের বেশ কয়েকটি প্রকল্প চালু আছে। এর মধ্যে অন্যতম কালাদান বন্দরকে কেন্দ্র করে কালাদান মাল্টি মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট।
এই প্রকল্পে পালতোয়া শহরের নদী বন্দর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহন করবে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যে সহজেই পণ্য পরিবহনের জন্য কালাদান বন্দর ব্যবহার করবে নয়া দিল্লি। এই প্রকল্পের অধীনে ভারতের কলকাতা বা বিশাখাপত্তমণ সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে বিভিন্ন পণ্য সমুদ্রপথে ছোট জাহাজে পাঠানো হবে মিয়ানমারের রাজধানী সিত্তেইয়ের কাছে কালাদান বন্দরে। ভারত থেকে যার দূরত্ব ৫০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। সেখান থেকে কালাদান নদী হয়ে সেই পণ্য পৌঁছবে পালতোয়া শহরের নদী বন্দরে। এরপর সড়ক পথে সেই পণ্য পৌঁছবে ভারতের মিজোরামের মিয়ানমার সীমান্তের জোরিনপুই শহরে। এর ফলে অনেক কম সময়ে কলকাতা থেকে পণ্য উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে পৌঁছে দেওয়া যাবে। কালাদান মাল্টি মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের অন্তর্গত অনেকগুলি উন্নয়নমূলক কাজ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। যেমন, মিয়ানমারের রাজধানী সিত্তেইয়ের নিকট কালাদান সমুদ্র বন্দর নির্মান ও পালতোয়া শহরে একটি নদী বন্দরের কাজ ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। এমনকি কালাদান নদীর ১৮৫ কিলোমিটার জলপথে ড্রেজিংয়ের কাজও হয়ে গিয়েছে। এখন নির্মানাধীন রয়েছে মিয়ানমারের পালতোয়া থেকে মিজোরামের জোরিনপুই শহর পর্যন্ত ১০৯ কিলোমিটার মহাসড়কের কাজ। কিন্তু মিয়ানমারের বর্তমান গৃহযুদ্ধ নিয়ে চিন্তায় ভারত সরকার।
যদিও মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বসে নেই ভারত। জানা যাচ্ছে, মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে ইতিমধ্যেই যোগাযোগ স্থাপন করেছে ভারত সরকার। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয়, চলতি বছরের মার্চ মাসে রাজ্যসভার সাংসদ কে ভ্যানলালাভেনা মিয়ানমারের অন্যতম প্রধান বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। মিজোরামের সাংসদ ভারত সরকারের প্রতিনিধি হয়ে প্রথমবার এই সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনায় বসেন। মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যমের দাবি, মূলত পালতোয়া থেকে মিজোরাম সীমান্ত পর্যন্ত ১০৯ কিমি মহাসড়কের নির্মান প্রসঙ্গেই আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনা করেন রাজ্যসভার সাংসদ কে ভ্যানলালাভেনা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন এই প্রকল্পের নির্মান সংস্থা ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা ইরকনের প্রতিনিধিরাও। রাখাইন প্রদেশের কোনও এক গোপন ডেরায় ভারতের প্রতিনিধি দল আরাকান আর্মির সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারের বেশিরভাগ সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির কর্তাদের নয়া দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ভারত। এই বৈঠকেও সদর্থক আলোচনা হয়েছে মিয়ানমারে চলা ভারতের প্রকল্পগুলির নিরাপত্তা নিয়ে। সূত্রের খবর, ভারতের বিদেশমন্ত্রকের সচিব বিক্রম মিশ্রি উপস্থিত ছিলেন থ্যাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককে এক ছয় দেশীয় আলোচনা সভায়। সেখানে তিনি মিয়ানমারের সেনা শাসক জুন্টাবাহিনীর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেন কালাদান প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে। সবমিলিয়ে আগামীদিনে যদি মিয়ানমার ভেঙে স্বাধীন আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে ভারতের কালাদান মাল্টি মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট কোনও ভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। যা আখেড়ে ভারতের বড় লাভ। কারণ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি যদি বাংলাদেশ প্রত্যাহারও করে নেয়, তাহলেও ভারতের খুব একটা ক্ষতি হবে না। বরং এর ফলে চাপ বাড়বে বাংলাদেশেরই।
Discussion about this post