আর কত নীচে নামবে বাংলাদেশ? যে মানুষটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নির্দ্বিধায়। যে মানুষটা স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে নিজের স্বপ্নকে জলাজঞ্জলি দিয়েছিলেন, সেই মানুষটাই আজ হতে হল চুরান্ত হেনস্থা। আমরা কথা বলছি কুমিল্লায় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই কানুকে নিয়ে। যাকে সম্প্রতি একদল ধর্মান্ধ জুতোর মালা পরিয়ে, কিল-চড়-ঘুষি সহযোগে হেনস্থা করেছে। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটেছে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের কুলিয়ারা। আর এই কুরুচিকর দৃশ্যের ভিডিও এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো ভাইরাল। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, কার্যত স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করে কোন পথে এগোতে চাইছে তৃতীয়বারের জন্য ‘স্বাধীন’ আজকের বাংলাদেশ?
গত ৫ আগস্ট তৃতীয়বার স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের পথে-ঘাটে এখন রীতিমতো ছড়ি ঘোরাচ্ছে ‘তৌহিদি জনতা’ নামে একদল ধর্মান্ধ মানুষ। জানা যাচ্ছে, আবদুল হাই ওরফে কানু নামে ৭৯ বছরের ওই বীর মুক্তিযোদ্ধা বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন বাজার করতে। পথেই তাঁকে ঘিরে ধরে ১৫-১৬ জনের একটা দল। ঘিরে ধরেই কিল-চড় পোশাক ধরে টানাটানি। বৃদ্ধ প্রশ্ন করতে থাকেন তাঁর অপরাধ কি, উত্তর ভেসে আসে ‘এ ব্যাটা মুক্তিযোদ্ধা’। এরপর ওই বৃদ্ধের গলায় জুতোর মালা পরিয়ে দেয় কেউ একজন। এরপর টেনে-হিঁচরে নিয়ে যাওয়া হয় সামনের দিকে। এরপর ওই ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায় ‘তৌহিদি জনতা’ ওই বৃদ্ধকে বলছে, ‘তুই নিজেকে আর কখনও মুক্তিযোদ্ধা বলবি না। চলে যাবি এই গ্রাম ছেড়ে, এখানে তোর থাকা চলবে না’। তারপর তাঁর সামনে একটা সাদা খাতা ও কলম দিয়ে নির্দেশ আসে সই করার জন্য। বিব্রত ও লাঞ্ছিত বৃদ্ধ সইও করে দেন চোখের জলে ভেসে। সঙ্গে সঙ্গেই এল নতুন নির্দেশ, ‘এত দিন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অহঙ্কার করেছিস, এর জন্য গ্রামের সকলের কাছে ক্ষমা চা। কে তোকে মুক্তিযুদ্ধ করতে বলেছিল?’
জবাবে জোড় হাত উপরে তুললেন বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা— তখন তাঁর গলায় ঝুলছে জুতোর মালা, দু’চোখ বেয়ে নেমে আসছে অশ্রুধারা। কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘সবার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি’। এই ভিডিও ভাইরাল হতেই চাপে পড়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের তদারকি সরকার। যদিও দাবি উঠছে, পুরো ঘটনার জন্য দায়ি জামায়তে ইসলামী। ফলে তাঁরাও প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ছেন। এই ঘটনা নিয়ে সমালোচনা শুরু হতেই জামাত শিবির নিজেদের ঘাড় থেকে দায় ঝেড়ে ফেলতে পদক্ষেপ নেয়। প্রবীন মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্থার ঘটনায় অভিযুক্ত দুই সমর্থককে বহিষ্কার করে জামায়তে ইসলামী। তাদের নাম মুহাম্মদ আবুল হাসেম, মুহাম্মদ অহিদুর রহমান। সংগঠনের কুমিল্লা জেলার প্রচার সচিব বেলাল হোসেন বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ‘‘চৌদ্দগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই কানুকে লাঞ্ছনার ঘটনায় আমরা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। এটি দুঃখজনক ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। জামাতে ইসলামি শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধা নয়, দেশের সাধারণ কোনও নাগরিককেও হেনস্তা করা সমর্থন করে না।
পরে নির্যাতিত বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা নিজেই বলেছেন, “এরা সকলেই পরিচিত লোক, জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মী”। ফলে বোঝাই যাচ্ছে কে বা কারা এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু কুমিল্লা জেলা পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি এই ঘটনায়। যদিও ঘটনার পরই বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। প্রশ্ন উঠছে, ‘তোহিদি জনতা’-র নামে কারা এই কাজ করল, তা ভাল ভাবেই দেখা গিয়েছে ভাইরাল ভিডিওতে। পুলিশের দাবি, তাঁদের চিহ্নিত করা গেলেও ধরা যায়নি। পুলিশের আরও দাবি, এরা কেউই স্থানীয় নন, ঢাকা ও গাজীপুরের বাসিন্দা। তাঁদের খোঁজ চলছে। কিন্তু আসল ঘটনা হল, এটাই এখন স্বাধীন বাংলাদেশ। যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও সম্মান করা হয় না। বরং তাঁদের প্রতিমুহূর্তে হেনস্থা ও লাঞ্ছিত হতে হয়। আর পুলিশ-প্রশাসন নির্বিকার হয়ে দর্শকের ভূমিকা নেয়।
Discussion about this post