চিত্রটা যেন কিছুতেই মিলছে না। লাগাতার আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ জননেত্রী হয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতার অলিন্দে ১৩ বছর ঘোরাঘুরি করার পর তিনি যেন আজ উল্টো পথের পথিক। ১৫ অক্টোবর গোটা দেশ দেখল এক অন্য কলকাতা। একদিকে রেড রোডে পুজো কার্নিভালে জাঁকজমকের মধ্যে মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর লেখা পুজোর থিমের গানের তালে নিজেই হাততালি দিলেন। কখনও আদিবাসী নৃত্যের তালে পা মেলালেন, আবার কখনও ডান্ডিয়া নাচলেন। হাজার ওয়াটের আলোর রোশনাই যেন তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হল এদিন। রেড রোডের ঠিক ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে তখন অন্য চিত্র। হাজার হাজার মানুষ প্রতিবাদে উদ্বেল। তাঁরা কখনও স্লোগান দিলেন ‘বিচার চাই’, কখনও আবার ‘জাস্টিস’ চেয়ে মুখরিত হলেন। জাস্টিস বা ন্যায় চেয়ে পথে নেমেছেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। যেখানে ন্যায়ের দাবি ওঠে, তার উল্টো পিঠে নিশ্চই থাকবে ‘অন্যায়’। যেন অদ্ভুত এক সমাপতন, একদিকে রেড রোডে হাজার ওয়াটের আলো ঝলমলে পুজো কার্নিভাল, অন্যদিকে মানুষের হাতে ওঠা মশালের আলোতে দ্রোহ কার্নিভাল। তবে স্বস্তি এই যা, এখনও তা দ্রোহ আছে, বিদ্রোহে পর্যবসিত হয়নি।
দুই মাস আগে আর জি কর হাসপাতালে কর্মরত এক পড়ুয়া তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার ঘিরে যার শুরু। যেখানে অপরাধ হয়, সেখানে সরকারের ভূমিকা থাকে সেই অপরাধের কিনারা করা, দোষীদের খুঁজে বার করে শাস্তির ব্যবস্থা করা। আর সেই অপরাধ যদি হয় ধর্ষণ করে খুনের মতো ঘটনা, তবে সেখানে আরও দায়িত্বশীল হতে হয় পুলিশ-প্রশাসনকে। কিন্তু আর জি কর কাণ্ডে হল তার উল্টো। ফলে বিগত দুই মাসে প্রতিবাদ বেড়েছে বই কমেনি। রাজ্য সরকারে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে এই প্রতিবাদ, আন্দোলন, বিক্ষোভ ও অনশন দমানোর। এখানেই বারবার প্রশ্ন উঠছে, রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যেখানে প্রতিবাদ, আন্দোলনের মাধ্যমেই রাজ্যের ক্ষমতা দখল করেছিলেন, সেখানে তিনি কিভাবে আজ উল্টো পথে হাঁটছেন?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নানা ভাবে চেষ্টা করছেন মানুষের এই প্রতিবাদকে দমন করার। রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনকে সর্বতভাবে কাজে লাগিয়েছেন তিনি। কিন্তু কোনও সাধারণ আন্দোলন যখন গণ আন্দোলনের রূপ নেয় তখন তা ঠেকানো অনেক সময়ই কঠিন হয়ে পড়ে। যেমন বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দক্ষ চালে সিঙ্গুর আন্দোলনকে গণ আন্দোলনে পরিবর্তিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর ফলস্বরুপ রাজ্যের বুকে চেপে বসা ৩৪ বছরের জগদ্দল পাথরের মতো বাম সরকারকে সমূলে উৎপাটিত করতে পেরেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তী ১৩ বছরেও বামফ্রন্ট আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গের বুকে। তবে এবার কিন্তু আন্দোলনের চরিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। কারণ আর জি কর আবহে যে আন্দোলনের প্রবাহ শুরু হয়েছে, বা চলছে সেটির নেতৃত্বে কেউ নেই। অর্থাৎ, নেতৃত্ব ছাড়াই এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে মহানগর থেকে গঞ্জ-গ্রামে। এটাকে গণ আন্দোলন ছাড়া আর কি বলা যায়। আন্দোলন শুরু করেছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। তাঁদের এক সহকর্মীর নির্মম পরিনতির বিচার চাইতে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এখন তা হয়ে উঠেছে মানুষের আন্দোলন। জুনিয়র ডাক্তাররা একত্রিত হয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সঙ্গ দিচ্ছেন সিনিয়র ডাক্তাররাও। এতে অবশ্যই হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা পরিষেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের তাতে কোনও ক্ষোভ নেই। দেখা যাচ্ছে কাতারে কাতারে মানুষ তাঁদেরই পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করছেন নিজেদের মতো করে।
কথায় আছে, বাংলা পথ দেখায় গোটা বিশ্বকে। আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে আজ বাংলায় যে আন্দোলন হচ্ছে, তা আগামীদিনে নিশ্চই পথ দেখাবে যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে হওয়া আন্দোলনকে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের আগ্রহ আর জি কর আবহে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ঘিরে। তিনি যে কোনও মূল্যে সাধারণ মানুষের এই স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিবাদ, আন্দোলনকে ঠেকাতে চাইছেন। যেখানে এক তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার বিচার চেয়ে আন্দোলন চলছে, সেখানে তিনি উৎসবে ফেরার ডাক দিচ্ছেন। আবার উৎসবের মাঝেই যখন কেউ কেউ প্রতিবাদ করছেন, তখন পুলিশ-প্রশাসন তাঁদের গ্রেফতার করে গারদে পুরছেন। বারবার কলকাতা হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কা খেতে হচ্ছে রাজ্য সরকারকে। তবুও তিনি অটল নিজের ভূমিকায়। একদিকে যখন জুনিয়র ডাক্তারদের ডাকা দ্রোহ কার্নিভালে হাজার হাজার মানুষ যুক্ত হলেন। ঠিক তার ৫০০ মিটারের মধ্যেই তিনি নাচলেন, গাইলেন, হাততালি দিলেন। পাঁচঘণ্টা ঠায় বসে উদযাপন করলেন পুজো কার্নিভাল। এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনতেই পারছেন না বাংলার মানুষ।
Discussion about this post