প্রথমে নাম ছিল সিভিক পুলিশ, পরে আইনের মারপ্যাঁচ এড়াতে নাম হয় সিভিক ভলান্টিয়ার। হাইকোর্টের বেঁধে দেওয়া কাজের পরিধি অনুযায়ী তাঁদের দায়িত্ব নিয়ন্ত্রনে থাকার কথা। কিন্তু আদতে তা হচ্ছে কি! রাজ্য জুড়ে সিভিক ভলান্টিয়ারদের রমরমা এবং দাপট কিন্তু অনেক কিছুই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বারবার। আপনাদের নিশ্চই মনে আছে প্রতিবাদী ছাত্র নেতা আনিস খান হত্যাকাণ্ডের কথা? সেখানেও নাম জড়িয়েছিল একজন সিভিক ভলান্টিয়ারের। যার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল কলকাতা হাইকোর্টেই। মামলা এমনই গড়িয়েছিল যে হাইকোর্টে দাঁড়িয়ে রাজ্যের তৎকালীন অ্যাডভোকেট জেনারেল গোপাল মুখোপাধ্যায় ব্যক্তিগত অভিমত বলে উল্লেখ করেছিলেন, “রাজ্য জুড়ে সিভিক নিয়োগ বন্ধ রাখা উচিৎ”। ফলে বোঝাই যাচ্ছে এই রাজ্যে সিভিক ভলান্টিয়াররা আদতে কতটা ক্ষমতাবান।
উল্লেখ্য, বিগত বাম জমানায় পশ্চিমবঙ্গে সিভিক ভলান্টিয়ার ছিলই না। তবে ২০০৮ সালে বাম আমলেই কলকাতায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রীণ পুলিশ নামে একটি বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। রাজ্যে পালাবদলের পর ২০১২ সালে তৃণমূল জমানায় রাজ্য পুলিশে সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। আর এর পর থেকেই নিয়ম করে এই সিভিক ভলান্টিয়ারদের দাদাগিরির ভুরিভুরি অভিযোগ আসতে শুরু করে। বিরোধীদের দাবি, সিভিক ভলান্টিয়ার আদতে তৃণমূলের আরেকটি বাহিনীতে পর্যবসিত হয়েছে। কেউ কেউ আরও এগিয়ে দাবি করেন, সিভিক ভলান্টিয়াররা আসলে শাসকদলের উর্দি পড়া ক্যাডার। যার প্রমান অতীতের আনিস হত্যাকাণ্ড বা সম্প্রতিক আর জি কর ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা। দুই জায়গাতেই অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার।
মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, রাজ্যে পর্যাপ্ত পুলিশকর্মীর অভাবে ২০১৩ সালে ৪০ হাজার পুলিশকর্মী এবং ১ লক্ষ ৩০ হাজার সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ইতিমধ্যেই প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ হয়েছে। নিয়ম মেনে পরীক্ষা এবং শারীরিক মাপজোকের মাধ্যমেই সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ হওয়ার কথা। কিন্তু আদতে তা হয় না বলেই অভিযোগ। মূলত স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের তৈরি করা প্যানেলেই সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ হয়। অনেকেই মনে করেন, সিভিক ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ পাওয়ার অন্যতম শর্তই হল শাসকদলের আনুগত্য। ফলে এলাকার প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় থাকার ফলে সিভিকদের ক্ষমতাও ব্যপক হয়ে ওঠে। বিরোধী নেতাদের অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় থানার বড়বাবুও কোনও সিভিক ভলান্টিয়ারের কথায় ওঠবোস করছেন।
আর জি কর কাণ্ডেও দেখা যাচ্ছে, ধৃত সঞ্জয় রায়ের পেশা নিয়ে উত্তর দিতে সংকোচ করছেন স্বয়ং নগরপাল বিনীত গোয়েল। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলেন, এ ক্ষেত্রে তাঁর পেশা জানার চেয়ে আমাদের কাছে তাঁর অপরাধের গুরুত্ব বেশি। এখানেই প্রশ্ন উঠছে, কে এই সঞ্জয় রায়? জানা যাচ্ছে, সঞ্জয় খাতায় কলমে কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মী। কিন্তু সেখানে একদিনও কাজ করেনি সে। আবার রাতারাতি পুলিশ ওয়েলফেয়ার কমিটির সদস্য হিসেবে জায়গা পেয়েছিল সঞ্জয়। সিভিক ভলান্টিয়ার হিসেবে তাঁকে অনেক জায়গায় ডিউটিও করতে দেখা গিয়েছিল বলে অভিযোগ।
তাঁর বাইকে পুলিশ স্টিকার লাগানো রয়েছে। এমনকি অনেক সময়ই তাঁকে কলকাতা পুলিশের লোগো এবং কেপি লেখা টি-শার্ট পড়েও ঘুরতে দেখা গিয়েছে। আর জি কর কাণ্ডে তাঁকে গ্রেফতারের পর স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তিতে পুলিশ কর্তারা। কারণ, সঞ্জয়ের পিছনে বড় কোনও প্রভাবশালীর হাত না থাকলে এভাবে তাঁর উত্থান সম্ভব হতো না। আবার পাকাপাকিভাবে থাকতেন কলকাতা পুলিশের চতুর্থ ব্যটালিয়নের ব্যারাকে। অথচ সঞ্জয়ের মতো কর্মীদের সেখানে থাকার অনুমতি নেই। তদন্তে উঠে আসছে, সঞ্জয়ের বাড়ি শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের কাছে হলেও তাঁকে হামেশাই দেখা যেত আর জি কর হাসপাতালে। সেখানে বিভিন্ন ওয়ার্ডে অবাধে যাতায়াত করতেন সঞ্জয়। তার প্রমান ঘটনার দিন অর্থাৎ গত শুক্রবার ভোররাতে মদ্যপ অবস্থায় আর জি কর হাসপাতালের চার তলায় সেমিনার হলের দিকে অনায়াসে উঠে যায়।
শুধু আর জি কর নয়, আরেক সিভিক ভলান্টিয়ারের কীর্তি সম্প্রতি সামনে এসেছে পূর্ব বর্ধমানের ভাতার থানা এলাকায়। সেখানকার এক সরকারি হাসপাতালের কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসককে হুমকি দিয়েছেন এক সিভিক ভলান্টিয়ার। রীতিমতো শাসানির সুরে শুশান্ত রায় নামে সিভিক ভলান্টিয়ার মদ্যপ অবস্থায় ওই মহিলা চিকিৎসককে বলেন, আর জি করে কী হয়েছে জানেন তো? যদিও পরে ওই সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করে ভাতার থানার পুলিশ। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কি ভাবে সিভিক ভলান্টিয়াররা এতটা দাপট দেখাতে পারছেন? ত্রিপুরার প্রাক্তন রাজ্যপাল তথা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তথাগত রায় একটি টুইট করে খোঁচা দিয়েছেন, জনৈক মহিলাকে ঘুষ খাইয়ে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করিয়ে মাননীয়া বলেছিলেন, ওরে বাবারে! আমি রাজভবনে যাব না! আজকে হুঁশিয়ার, পশ্চিমবঙ্গের সাত থেকে সাতাত্তর নারী! সিভিক ভলান্টিয়ার থেকে সাবধান! ওরা কামড়ে দেয়।
Discussion about this post