ইন্দিরা গান্ধি, ভারতের ইতিহাসে এক সর্বজনবিদিত প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সময়কালে ভারত বেশ কয়েকটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিল। তেমনই দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ভারতে লাগু ছিল জরুরি অবস্থা। সেই কারণে তাঁকে অনেক সময়ই ইন্দিরা গান্ধিকে কাঠগড়ায় তোলেন বিরোধীরা। কিন্তু সেই দোর্দন্ডোপ্রতাপ ইন্দিরা গান্ধিকেই একবার জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেছিল বাম ছাত্র সংগঠন। আর সেটা হয়েছিল ১৯৭৭ সালেই, জরুরি অবস্থা ওঠার অব্যবহিত পরপর। এই একই কায়দায় ২০২৪ সালে আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে কলকাতার নগরপালকে ইস্তফা দেওয়ার দাবি জানালেন আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারা। দুটি ঘটনার মধ্যে মিল অনেক থাকলেও অমিলও আছে।
১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর
দিল্লির ঐতিহ্যবাহী জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে ছাত্র আন্দোলন। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি। সেই আন্দোলনে দাবি উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদ থেকে ইস্তফা দিতে হবে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রীকে ক্যাম্পাসে এসে তাঁদের দাবিপত্র গ্রহন করতে হবে। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি। সীতারাম ইয়েচুরির কথায়, ওই দিন আচমকাই ইন্দিরা গান্ধি ক্যাম্পাসে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। তবে ইন্দিরা গান্ধি সেদিন কোনও পুলিশি নিরাপত্তা না নিয়েই এসেছিলেন জেএনইউ ক্যাম্পাসে। সেখানে তখন উপস্থিত প্রায় ৬০০ ছাত্র। প্রধানমন্ত্রী তথা আচার্য ইন্দিরা গান্ধির সামনেই তাঁর পদত্যাগ চেয়ে দাবিপত্র পাঠ করে শোনানো হয়। পরে তিনি সেই দাবিপত্র নিয়ে ফিরে যান এবং পরদিনই জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন।
২০২৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর
কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নৃশংশ ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় লালবাজার অভিযানে জুনিয়র চিকিৎসরা। লালবাজারের ধারেকাছে ঘেঁষতে না পেরে তাঁরা রাতভর ধর্ণায় বসেছেন ফিয়ার্স লেনের সামনে। আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি, কলকাতার নগরপালের পদত্যাগ। এই দাবিপত্র নগরপাল বিনীত গোয়েলের হাতেই তুলে দিতে চান তাঁরা। কিন্তু জুনিয়র চিকিৎসকরা ২২ ঘণ্টার বেশি ফিয়ার্স লেনে বসে থাকলেন খোলা আকাশের নীচে। কিন্তু কলকাতার নগরপাল এলেন না। বদলে বারবার পাঠালেন অধস্তন আধিকারিকদের। কিন্তু চিকিৎসক পড়ুয়ারা নিজেদের দাবিতে অনড়। শেষ পর্যন্ত একটা রফাসূত্র বের হয়। লালবাজার পড়ুয়াদের মিছিল ১০০ মিটার এগিয়ে নিয়ে যাওযার অনুমতি দেয়। এবং নগরপালের কাছে দাবীপত্র জমা দেওয়ার অনুমতি মেলে। জুনিয়র চিকিৎসকদের ২২ জনের প্রতিনিধি লালবাজারের ভিতর ঢুকলেন প্রতীকী শিড়দাঁড়া সঙ্গে নিয়ে। নগরপাল বিনীত গোয়েলের হাতেই তুলে দিলেন তাঁর ইস্তফার দাবিপত্র। এবং ওই প্রতীকী শিড়দাঁড়াটিও রেখে এলেন তাঁর টেবিলে। কিন্তু বিনীত গোয়েল তাঁর চেয়ার ছেড়ে রাস্তায় এলেন না। পড়ুয়াদের দাবি যাই হোক, সহানুভুতির সঙ্গে তাঁদের সঙ্গে দেখা করলেন না। যেমনটা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি।
দেশের প্রধানমন্ত্রী, জেএনইউ-র আচার্য হয়েও সেদিন ইন্দিরা গান্ধি বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা রেখে, তাঁর পদের মর্যাদা রেখে তিনি নিরাপত্তাকর্মীদের বাইরে রেখেই ক্যাম্পাসের ভিতর ঢুকেছিলেন। এমনকি শান্ত হয়ে তাঁরই ইস্তফার দাবি শুনেছিলেন ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে। পরদিনই দাবি মেনে ইস্তফাও দিয়েছিলেন। কিন্তু কলকাতার নগরপাল সে সবের ধারও ধারলে না। বরং লালবাজারের ভিতর বসে থাকলেন তাঁর শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বারে। সারা রাত ধরে খোলা আকাশের নীচে যখন চিকিৎসক পড়ুয়ারা বসে থাকলেন লালবাজারের সামনে। তখন তিনি পিছনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে বাড়ি ফিরলেন। এখানেই পরিস্কার নগরপালের ঔদ্ধ্বত্য। তিনি শেষ পর্যন্ত পড়ুয়াদের দাবিপত্র নিলেন। তবে নিজের চেম্বারে বসেই। যা ইন্দিরা গান্ধি প্রধানমন্ত্রী হয়েও করেননি।
Discussion about this post