আগস্ট মাসের ৫ তারিখ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছিলেন শেখ হাসিনা। সেই দিনই বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। যদিও সেই সময়ই হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের দাবি ছিল, তাঁর মা দেশ ছাড়ার আগে পদত্যাগ করেননি। এরপর কেটে গিয়েছে প্রায় সাড়ে তিনমাস। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক পালাবদল হয়েছে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন তদারকি সরকার। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও একটি বিতর্ক কখনও থেমে থাকেনি। সেটা হল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা কী আদৌ পদত্যাগ করেছিলেন? এবার সেই বিতর্কের আগুনে ঘি ঢাললেন স্বয়ং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ শাহবুদ্দিন চুপ্পু। তাঁর সাম্প্রতিক দাবি, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, এমন কোনও প্রামাণ্য নথি তাঁর কাছে নেই। অর্থাৎ, হাসিনার পদত্যাগপত্র তাঁর হাতে পৌঁছয়নি। যা নিয়ে উত্তাল বাংলাদেশের রাজনীতি।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সংবাদপত্র মানবজমিন-কে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মহম্মদ শাহবুদ্দিন চুপ্পু। ওই পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র আমি অনেক খুঁজেছি। কেউ দেখাতে পারেননি। আমি মন্ত্রী পরিষদ সচিবের কাছে কপি চেয়েছিলাম। উল্টে তিনি আমার অফিসে এসে একদিন শেখ হাসিনার পদত্যাগ পত্রের কপি খোঁজ করেন’। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির এহেন মন্তব্যের পর তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার কয়েকদিন পর একটি টেলিফোনিক কখপোকথন ভাইরাল হয়েছিল। সেখানে হাসিনাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘আমি এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। আমি পদত্যাগ করিনি। চ্যালেঞ্জ করছি, অন্তর্বর্তী সরকার আমার পদত্যাগপত্র দেখাক’। এদিন রাষ্ট্রপতির বক্তব্যেও সেই একই দাবি প্রতিফলিত হল। ফলে আদৌ হাসিনা পদত্যাগ করেছিলেন কিনা সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়ে গেল।
গত ৫ আগস্ট গণভবনে ঠিক কি হয়েছিল? রাষ্ট্রপতি শাহবুদ্দিন এরও একটা বর্ণনা দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “চারদিকে অস্থিরতার খবর। কী হতে যাচ্ছে জানি না। আমি তো গুজবের ওপর নির্ভর করে বসে থাকতে পারি না। তাই সামরিক সচিব জেনারেল আদিলকে বললাম খোঁজ নিতে। তার কাছেও কোনো খবর নেই। আমরা অপেক্ষা করছি। টেলিভিশনের স্ক্রলও দেখছি। কোথাও কোনো খবর নেই। এক পর্যায়ে শুনলাম, তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আমাকে কিছুই বলে গেলেন না। যা সত্য তাই আপনাকে বললাম”। তিনি এও দাবি করেন, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার যখন বঙ্গভবনে এলেন তখন জানার চেষ্টা করেছি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন কি না? একই জবাব। শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। মনে হয় সে সময় পাননি জানানোর। যদিও ৫ অগাস্ট রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। আমি তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছি।’ অর্থাৎ তিনি নিজেই নিজের আগের মন্তব্যের বিরোধীতা করছেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্যের জেরে নিঃসন্দেহে চাপে পড়ে গেল বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কারণ, তাঁরা ইতিমধ্যেই বারবার দাবি করে আসছে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। রাষ্ট্রপতির বয়ানের পর সেই দাবি মিথ্যা প্রমানিত হচ্ছে। যদিও রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন, সেই সময় উদ্ভুত পরিস্থিতি বিবেচনা করে কি করণীয় সেটা জানতে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চেয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ ৮ই আগস্ট এ সম্পর্কে তাঁদের মতামত দেন। এতে বলা হয়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা দূর করতে এবং নির্বাহী কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টামণ্ডলীকে শপথবাক্য পাঠ করাতে পারবেন। সেই মতোই তিনি তদারকি সরকারের গঠন করেন বলে দাবি রাষ্ট্রপতির।
প্রসঙ্গত, সাংবাদিক মতুয়ুর রহমান চৌধুরী হাসিনা সরকারের কট্টর সমালোচক ছিলেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে তাঁর প্রবেশাধিকারও ছিল না। কোটা আন্দোলনের সময় তাঁর লেখালেখি নিয়ে অনেক বিধিনিষেধ জারি করে হাসিনা সরকার। এমনকি সে সময় তাঁকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। পরে তিনি দেশে ফেরেন এবং রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎকার নিয়ে সেই হাসিনাকেই সুযোগ করে দিলেন আন্তর্জাতিক আদালতে আইনি লড়াইয়ে মোকাবিলা করার। এই প্রতিবেদনে প্রবীন ওই সাংবাদিক দাবি করেছেন, হাসিনাকে একপ্রকার চাপের মুখে দেশ ছাড়তে হয়েছে। তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন। ভাষণের খসড়া তৈরি ছিল। তাতে লিখেছিলেন, চাপের মুখে দেশ ছাড়ছি। সেই সঙ্গে দেশের জন্য তাঁর অবদানের বিবরণ ছিল। কিন্তু ভাষণ রেকর্ড করতে দেওয়া হয়নি তাঁকে। সবমিলিয়ে চাপে থাকা হাসিনা এই ঘটনার পর অনেকটাই সুবিধাজনক জায়গায় চলে এল। কারণ, ইতিমধ্যেই মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের কার্যকলাপ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের একটা অংশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। এমনকি সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশও ক্ষিপ্ত। আপাতত সেনাপ্রধান মার্কিন সফরে রয়েছেন। তিনি ফিরলে বাংলাদেশে নতুন করে আলোড়নজনক কিছু হতে পারে বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।
Discussion about this post