জুলাই-আগস্টের বিপ্লব, বাংলাদেশে এখন গণ অভ্যাউত্থানকে এভাবেই ব্যাখা করা হচ্ছে। যার মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়, প্রধানমন্ত্রীত্ব ও দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় শেখ হাসিনা। তিনি যখন দেশ ছাড়েন, তখন কয়েক’শ মানুষের মৃত্যুতে মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজপথ রক্তাক্ত। শেখ হাসিনা কার্যত নিঃশব্দে বোন শেখ রেহানার সঙ্গে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে চেপে দেশ ছাড়েন। এরপর থেকে তাঁর আশ্রয় দিল্লি। অর্থাৎ বাংলাদেশের পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে আশ্রয় দিয়েছে ভারতবর্ষ। তবে এটা প্রথমবার নয়, এর আগেও বিপদের দিনে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। কিন্তু তখন প্রেক্ষাপট ছিল আলাদা, ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতাও ছিল ভিন্ন। এখন যেমন বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায়, সেই সময় ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। এখন নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী, সেই সময় ছিলেন ইন্দিরা গন্ধি। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয়, শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লিগকে নিয়ে ভারতের অবস্থান বরাবরই এক ও অভিন্ন। এর যথেষ্ট কারণও আছে।
আজ থেকে ৪৯ বছর আগে জুলাই মাসে এভাবেই দেশ ছেড়েছিলেন শেখ হাসিনা। যদিও সেদিন তিনি জানতেন না এটাই তাঁর বাবা মুজিবর রহমানের সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা হতে চলেছে। ঠিক ১৫ দিনের মাথায় হাসিনা খবর পান, তাঁর বাবা অর্থাৎ বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবর রহমান-সহ তাঁরা প্রায় গোটা পরিবারকেই খতম করে দেওয়া হয়েছে। হাসিনার পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাইয়ের সেই অভিসপ্ত রাতে। তালিকায় বাদ জায়নি হাসিনার ১০ বছরের ভাইও। সেবারও আর দেশে ফিরতে পারেননি শেখ হাসিনা এবং তাঁর বোন রেহানা। পরের পাঁচ বছর তাঁরা ভারতেই আশ্রয় পেয়েছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি তাঁদের ভারতে আশ্রয় দেন পরম মমতায়। ইন্দিরা গান্ধীর তত্ত্বাবধানে জার্মানি থেকে ভারতে উড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল হাসিনা ও রেহানাকে। তখনও তাঁরা জানতেন না তাঁদের পরিবারের সকল সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি, মুজিবরের দুই মেয়ে এবং তাঁদের স্বামী-সন্তানদের জন্য দিল্লির পাণ্ডারা রোডের অভিজাত এলাকায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। হাসিনার দুই সন্তান তখন ছোট।
পরবর্তী সময় সেই পাঁচ বছরের নানান গল্প হাসিনার মুখে শোনা গিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধির প্রতি কৃতজ্ঞতাও তিনি বারবার ব্যক্ত করেছেন। হাসিনা জানিয়েছিলেন, তাঁদের নিরাপত্তার স্বার্থে নাম বদল করে দেওয়া হয়েছিল। এবং পাঁচ বছর সেই নামেই অতি গোপনে ভারত সরকার দিল্লিতে কার্যত লুকিয়ে রেখেছিল। পরবর্তী সময় দেশে ফিরলেও হাসিনার উপর অনেকবার হামলার ঘটনা ঘটে। কখনও গ্রেনেড হামলা, কখনও বা বোমা ও গুলি চালানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু শেখ হাসিনাকে বারবার ভারত সরকার যে ভাবে সাহায্য করেছে সে কথা তিনি কোনও দিনও স্বীকার করতে কার্পণ্য করেননি। এবারও যখন তিনি বিপদে পড়েছেন, ভারত কয়েক মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁকে আশ্রয় দেওয়া হবে। এমনকি পরে হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠকে কংগ্রেস-সহ প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই কেন্দ্রীয় সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। এর থেকেই বোঝা যায়, শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লিগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বরাবরই মধুর।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বা না থাকাকালীন যতবারই ভারতে এসেছেন, ততবারই তিনি গান্ধি পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। আবার কলকাতায় এলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও দেখা করেন। হাসিনার সঙ্গে যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহের সম্পর্ক, তেমনই ছিল প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। প্রণববাবুর স্ত্রী ও পুত্রের সঙ্গেও আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল শেখ হাসিনার। বর্তমানে যেমন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক সর্বজনবিদিত। ফলে ভারতে যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকুক, শেখ হাসিনা ভারতে এলে সর্বোচ্চ আতিথেয়তা পাবেন, এটা বলাই বাহুল্য।
Discussion about this post