মিয়ানমারের অন্তর্গত প্রায় ২২ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত রাখাইন প্রদেশ। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই রাজ্য নিয়ে এখন অসীম লড়াই চলছে। সম্প্রতি মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি এই রাখাইন প্রদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ দখল নিয়েছে সে দেশের সেনা শাসকদের থেকে। মিয়ানমার সেনার সদর-সহ হাতে গোনা একটি-দুটি পোস্ট দখল নিলেই পুরো রাখাইন প্রদেশ আরাকান আর্মির দখলে চলে আসবে। যা নিয়ে এখন জোর যুদ্ধ চলছে। তবে এই মুহূর্তে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ লাগোয়া বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় ২৭১ কিলোমিটার এখন আরাকান আর্মির দখলে। যা বাংলাদেশের ইউনূস সরকারের মাথাব্যাথার কারণ। অনেকেই দাবি করছেন, আরাকান আর্মির নজরে এখন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম। আবার কেউ কেউ দাবি করছেন, বাংলাদেশ নাকি রাখাইন প্রদেশ বা পুর্বতন আরাকান রাজ্যের দখন নেবে। তবে এই বিষয়ে সরকারিভাবে কোনও ঘোষণা নেই। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে এই আরাকান রাজ্য একসময় অখণ্ড বাংলার অংশ ছিল। আরাকান ও বাংলাদেশের সঙ্গে ছিল গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক।
বর্তমানে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলিতে আশ্রয় নেওয়া ১২ লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এই আরাকান প্রদেশেরই বাসিন্দা। যারা মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আজ ঘর-বাড়ি-ভিটে ছাড়া হয়ে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলিতে এসে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। ইতিহাস বলছে এই রোহিঙ্গারা কোনও দিনও পরাধিন ছিল না। এককালে তাঁদেরও ছিল একটা স্বাধীন রাজ্য, যার নাম ছিল রাখাইন, আদি নাম আরাকান। জনশ্রুতি, সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে একটি জাহাজডুবি হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ওই জাহাজের যাত্রী ও নাবিকরা বেঁচে যান। তাঁরা কোনও ক্রমে কাছের উপকূলে গিয়ে আশ্রয় নেন। বেঁচে যাওয়া ওই যাত্রীরা বলতেন আল্লাহ-র রহমতে বেঁচে গিয়েছি। জানা যায়, সেই রহম থেকে নতুন জন্ম হওয়া থেকেই আজকের রোহিঙ্গা জনজাতির উৎপত্তি। পরবর্তী সময় চট্টগ্রাম, রাখাইন প্রদেশগুলিতে এই রোহিঙ্গারা বিস্তার লাভ করে। সপ্তম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত এই অঞ্চলে রোহিঙ্গা, বার্মিজ, বাঙালি ও মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের সংমিশ্রনে এই জাতি পূর্ণাঙ্গতা পায়। ফলে আরাকান মুসলমানদের রয়েছে এক গৌরবময় অতীত। ১৮২৪ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বার্মা দখল করে নেয়। এরপর পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর আরাকানের মা্নুষজন অনেকটা শান্তি ও স্বস্তিতে ছিলেন। কিন্তু কাল হয়ে দাঁড়াল আরাকানের খণিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ।
এই অঞ্চলে কয়লা, তেলের মতো খণিজের বিপুল ভাণ্ডারের খোঁজ পায় ব্রিটিশরা। এমনকি আরাকান প্রদেশে সোনা ও রুপার মতো দামী ধাতুর অস্তিত্বও পাওয়া যায়। যার ফলে এই এলাকার দখল নিয়ে শুরু হল লডাই। একেক সময় একেক দেশ এই আরাকান বা রাখাইন প্রদেশের দখল নিয়েছিল। কখনও ব্রিটেন, কখনও আমেরিকা, কখনও জাপানিদের দখলে যায় আরাকান। কিন্তু ১৯৪৫ সালের পর থেকে এই রাখাইন ছিল ব্রিটিশদের দখলে। ইতিহাস বলছে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হওয়ার সময় এই রাখাইন প্রদেশের মুসলিমরা ব্রিটিশ প্রশাসনকে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হওয়ার আর্জি জানিয়েছিল। কিন্তু মুহাম্মদ আলি জিন্না ও পণ্ডিত নেহেরুর উদাসিনতার কারণে রাখাইন মিয়ানমারের অংশ হয়েই থেকে যায়। ইতিহাসবিদরা দাবি করেন, মহম্মদ আলি জিন্না আরাকান সম্পর্কে একটু সজাগ থাকলে আজ রোহিঙ্গাদের ইতিহাস একেবারেই পাল্টে যেতে পারতো। পূর্বতন আরাকান ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের অংশ ছিল না, একসময় ছিল স্বাধীন ও বাংলার অংশ ছিল। তাই তাঁরা চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হতে। কিন্তু জিন্নার অবহেলার কারণেই বার্মা আরাকানের দখল নিয়ে নেয়।
জানা যায়, ২০০০ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের প্রচেষ্টায় এক মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি রাখাইন প্রদেশকে বাংলাদেশের অংশ হিসেবে জুড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মার্কিন কংগ্রেসের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সংক্রান্ত উপকমিটির চেয়ারম্যান ব্রাড সারমান এই প্রস্তাব দেন। কিন্তু বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে প্রস্তাব নাকচ করে বলেছিলেন, ১ লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গকিমি আয়তনের বাংলাদেশ নিয়েই আমরা ভালো আছি। অন্যের জমি দখল নেওয়ার কোনও বাসনা আমাদের নেই। ফলে রোহিঙ্গা অধুষ্যিত রাখাইন প্রদেশ ফের মিয়ানমারের অংশ হয়েই থেকে যায়। বর্তমানে মিয়ানমারের বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী আরাকান আর্মি রাখাইন প্রদেশের দখল প্রায় নিয়ে নিয়েছে। ফলে তাঁরা পরবর্তী সময় চট্টগ্রাম দখল নেওয়ার চেষ্টা করবে না, এ কথা হলফ করে কেউ দাবি করতে পারবেন না। ফলে এই আরাকান আর্মি নিয়ে যথেষ্টাই চিন্তিত থাকতে হবে বাংলাদেশের তদারকি সরকারকে।
Discussion about this post