সত্যজিৎ রায়ের সেই বিখ্যাত সিনেমা হীরক রাজার দেশ নিশ্চই দেখেছেন? আজকের পশ্চিমবঙ্গ ঠিক যেন সেই গল্পের প্রেক্ষাপট। ন্যায্য চাকরি হারিয়েও শিক্ষকরা পুলিশের লাঠি খাচ্ছেন। নির্বিকার মুখ্যমন্ত্রী, দায় ঠেলছেন বিরোধীদের! উদয়ন পণ্ডিতের কথা আপনাদের মনে আছে? ওই যে সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি হীরক রাজার দেশে সিনেমার এক চরিত্র। সেই উদয়ন পণ্ডিত একজন শিক্ষক ছিলেন। রূপকের আশ্রয় নিয়ে ওই চলচ্চিত্রটিতে কিছু ধ্রুব সত্য ফুটিয়ে তুলেছিলেন সত্যজিৎ রায়। সেটা ছিল আশির দশক, আর চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট আরও পুরোনো। সেই সিনেমায় হীরক রাজা এক মগজ ধোলাই যন্ত্রে সকল পড়ুয়াদের ঢুকিয়ে শিখিয়েছিলেন কয়েকটা মন্ত্র। যেমন, “লেখাপড়া করে যে, অনাহারে মরে সে” বা “জানার কোন শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই”। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অবস্থা, সেই হীরক রাজার দেশের মতোই বলা যায়। এক ধাক্কায় প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষা কর্মীর চাকরি বাতিল হয়ে গিয়েছে। এত বড় দুর্নীতির নজির স্বাধীন ভারতে খুব কমই রয়েছে। ভারতের দুর্নীতির অভাব নেই কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগে দুর্নীতির পশ্চিমবঙ্গের প্রায় প্রতিটি স্তরেই অভিযোগ উঠেছে। প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক প্রায় সব স্তরেই অভিযোগ রয়েছে। এই ২৬ হাজার শিক্ষক শিক্ষিকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের। আদালতে বিচারাধীন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ মামলা, সেখানেও বড়সড় ধাক্কা খেতে পারে রাজ্য সরকার, বাতিল হতে পারে কয়েক হাজার শিক্ষকের নিয়োগ। ব্যাপারটা ঠিক একইরকম “লেখাপড়া করে যে অনাহারে মরে সে”। যারা যোগ্য যারা দুর্দান্ত ফল করে প্রতিটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তারাও আজ চাকরিহারা। যারা ঘুষ দিয়ে তৃণমূলের দাদা দিদিদের লেজ ধরে শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি আদায় করেছিলেন, সেই অযোগ্যদের সঙ্গে একই আসনে আজ মেধাবী ও যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা। তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে দল বার করতে গেলে খেতে হচ্ছে পুলিশের লাঠি, লাথি-জুতো। হীরক রাজার দেশের সেই মন্ত্র ২০২৫-এ এসে সামান্য বদলে গিয়েছে, “লেখাপড়া করে যে লাঠি পেটা খায় সে”।
দায়ী কে? ব্যাপক দুর্নীতি যে হয়েছে সেটা আদালতেই প্রমাণ হয়েছে। দেশের শীর্ষ আদালতও তাতে সায় দিয়েছে। কেউ সাদা কথা জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন কেউ দু-চারটে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চাকরি পেয়েছেন কেউ নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধের পরেও চাকরি পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সিবিআইয়ের দাবি, অন্তত সতেরো ধরনের উপায়ে দুর্নীতি হয়েছে এই শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। এটা ভাবতেই অনেকের গায়ে কাঁটা দেবে, কিন্তু আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ওই চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সামনে অনর্গল মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে গেলেন। পাশাপাশি তাঁর দাবি, বাম ও বিজেপি ষড়যন্ত্র করে এই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চাকরি কেড়ে নিয়েছে। অর্থাৎ তাঁর দলের কোনও দোষ নেই। এদিকে দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর অধীনস্ত পূর্বতন শিক্ষামন্ত্রী-সহ পুরো শিক্ষা দফতরটাই কার্যত জেলে রয়েছে। কিন্তু চোরের মায়ের বড় গলা, তাই তিনি নেতাজি ইনডোরে দাঁড়িয়ে অবলীলায় মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে গেলেন।
হীরক রাজা যেমন নিজের মতো করে তাঁর রাজ্য শাসন করতেন, এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও ঠিক তেমন। তাঁর কাছে আমলা, মন্ত্রী, পুলিশ কর্তা সবাই সমান। তিনিই প্রশাসন, তিনিই শাসক। ফলে একদিকে তাঁর দলের নেতা মন্ত্রীরা ঘুষ নিয়ে, কাটমানি নিয়ে নিজেদের পকেট ভরাচ্ছেন। এর মধ্যে কিছু টাকা হয়তো দলের তাহবিলে যায়। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা দলের সর্বোচ্চ নেত্রী হিসেবে তিনি কিছুই জানেন না। “যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান”। এখানেও ঠিক তাই। চাকরি চলে যাচ্ছে শিক্ষকদের, অথচ প্রতিবাদ করা যাবে না। তাহলেই পিঠে পড়বে পুলিশের লাঠি ও লাথি।
Discussion about this post