মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্প আসার পর থেকেই ক্রমশ ও পরিবর্তন হচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভূ রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই গোলমেলে হয়ে গিয়েছে। যার নেপথ্যে রয়েছে ভারতের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ। গত বছর ৫ আগস্টে আওয়ামীলীগ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে বাংলাদেশ ঘিরে ঘটে চলেছে নানান ঘটনা। একদিকে পাকিস্তান, চিন এবং অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেশী বৃহৎ দেশ হিসাবে ভারত তো ছিলই, এবার সেই আবহে ঢুকে পড়ল রাশিয়া।
গত ২৮ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল, ২০২৫ পর্যন্ত ভারত ও রাশিয়ার নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে যৌথ নৌ মহড়া দেয়। যার পোশাকি নাম ছিল ‘ইন্দিরা-২০২৫’। মহড়া শেষে আমরা দেখলাম তিনটি রাশিয়ান যুদ্ধ জাহাজ আচমকা প্রবেশ করল বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে। গত রবিবার অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ ‘রেজিক’, ‘হিরো অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন আলদার সিডেনঝপভ’ এবং ‘পেচেঙ্গা’ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছিল। আগামীকাল অর্থাৎ ১৬ এপ্রিল তাঁদের রাশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা। বাংলাদেশের তরফে বলা হচ্ছে চারদিনের শুভেচ্ছা সফরে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছি এই তিনটি রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ। কিন্তু আদৌ কি বিষয়টি তাই? বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে এর নানান ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে।
গত মাসে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস চিন সফরে যাওয়ার সময়ই আচমকাই ঢাকায় হাজির হয়েছিলেন কয়েকজন মার্কিন উচ্চপদস্থ সেনা কর্তা। তাঁরা কেউই ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেননি, বরং একাধিক বৈঠক করেছিলেন বাংলাদেশ সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান ও কয়েকজন বাংলাদেশী সেনা কর্তার সঙ্গে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তখন বলেছিল সেটা ছিল নিখাদ সৌজন্য সাক্ষাৎ। পরে জানা গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে মিয়ানমারে একটি করিডর চাইছে। আরাকান আর্মির অধীনে থাকা রাখাইন প্রদেশে মার্কিন সেনা ঢুকতে চায় বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে। মনে রাখা প্রয়োজন বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ওপর বহুদিনের নজর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। মিয়ানমারের অস্থিরতা এবং আরাকান আর্মির অগ্রাসী মনোভাব দেখে এবার মিয়ানমারে চিনের কর্তৃত্ব কমাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাখাইন প্রদেশের দিকে হাত বাড়িয়েছিল বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক মহলের একাংশ।
কিন্তু আমরা দেখলাম চিন সফরে গিয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস একটা কাঁচা কাজ করে বসলেন। চিনের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভারতের সেভেন সিস্টার্সকে উপেক্ষা করেই চিনকে স্বাগত জানালেন বাংলাদেশে বাণিজ্য করতে। নিজেদের “অনলি গার্ডিয়ান অফ দ্য ওসেন” বলে দাবি করে চিনা অর্থনীতি সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশকে উন্মুক্ত করে দিলেন। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর এবং লালমনিরহাট বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য চিনকে আহ্বান জানালেন ইউনূস। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার এহেন মন্তব্যের পর একদিকে যেমন ক্ষেপে গেল ভারত ঠিক একইভাবে ক্ষেপলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। কারণ, চিনকে আহ্বান জানানো মানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা।
ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা খুব একটা সহজ ব্যপার নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প আসার পর থেকে অনেকেই ভেবেছিলেন ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাখামাখি সম্পর্ক তৈরি হবে। কিন্তু ট্যারিফ নিয়ে ভারতের অনমনীয় মনোভাব সেই সম্পর্কে কিছুটা হলেও চোনা ফেলেছে। আবার ভারতকে না জানিয়েই বাংলাদেশে মার্কিন সেনাকর্তাদের পাঠানো ভারত ভালোভাবে মেনে নেয়নি। ফলে একদিকে চিন, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশকে ঘিরে দুই মহা শক্তিধর দেশের ঠান্ডা লড়াই প্রসমিত করতেই বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান ছুঁটে গেলেন রাশিয়ায়। সেখানে একাধিক বৈঠক করলেন এবং ফিরে আসার পরপরই দেখা গেল তিন রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ নোঙড় করল চট্টগ্রামে।
কূটনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছেন, ভারতের পরামর্শেই রাশিয়া সফর করলেন জেনারেল ওয়াকার উজ জামান। কারণ বরাবরই রাশিয়া ভারতের খুব কাছের বন্ধু হিসেবে নিজেকে প্রমান করেছে। সেই ১৯৭১ সালে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে বাংলাদেশের জন্ম হল, তখনও ভারতের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বঙ্গোপসাগরে রণতরী পাঠিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ফলে পাকিস্তানকে সাহায্য করতে পাঠানো মার্কিন রণতরী ঢুকতেই পারেনি বঙ্গোপসাগরে। এরপর ১৯৭৪ সালে রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে থেকে সাগরের নিচে ভারতের বিছিয়ে রাখা মাইন নিস্কৃয় করেছিল। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর সবধরণের জাহাজ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হতে পেরেছিল। এবারও সঙ্কটকালে ভারতের অনুরোধে রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ চট্টগ্রামে নোঙড় করেছে। এটা বোঝাতে, বাংলাদেশের দিকে যেই হাত বাড়াক না কেন এখানে বাঁধার মুখে পড়তে হবে। ফলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফল কূটনৈতিক চাল এবং বাংলাদেশ সেনাপ্রধানের উপস্থিত বুদ্ধি এ যাত্রায় ফের চিন ও মার্কিন অগ্রাসন ঠেকানো গেল।
Discussion about this post