সত্যজিৎ রায়ের একটি গল্প ছিল, “যত কাণ্ড কাটমান্ডুতে”। বর্তমান সময়ের নীরিখে সেই গল্পের নামকরণকে একটু পাল্টে বলাই যায় যত কাণ্ড ঢাকায়। এক বৃহত্তর পরিকল্পনার মাধ্যমে গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদল হয়। জনগণের ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর শাগরেদরা। তাঁদের অর্থ ও পরামর্শ জুগিয়েছিল মার্কিন ডিপ স্টেট এবং পাক আইএসআই। আজ এই বিষয়টি জলের মতো পরিস্কার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কেন বাংলাদেশকে ঘিরে এত বড় ষড়যন্ত্র, শেখ হাসিনাই বা কোন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছিলেন, যে তাঁকে এত নিষ্ঠুরভাবে সরানো হল। উত্তরটা হল বঙ্গোপসাগর।
বাংলাদেশের বর্তমান শাসক মুহাম্মদ ইউনূস যেমন বলেছেন, “উই আর দ্য ওনলি গার্ডিয়ান অফ দ্য ওসেন”। নিন্দুকেরা বলেন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ আসলে ওসেন বলতে ভারত মহাসাগরকেই বোঝাতে চেয়েছেন, বঙ্গোপসাগর তো তারই একটা অংশ। বঙ্গোপসাগর হয়ে আন্তর্জাতিক সমুদ্র বাণিজ্যের একটা বড় অংশের জাহাজ চলাচল করে। যা নিয়ন্ত্রণ করে ভারত। অপরদিকে মালাক্কা প্রণালী হয়ে চিনের অধিকাংশ তেল ও গ্যাস পরিবাহী জাহাজ যাতায়াত করে আন্দামান সাগর ও ভারত মহাসাগর হয়ে। ফলে চিনের প্রয়োজন এমন একটা নৌঘাঁটি যেখান থেকে পুরো সাগর তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও ইচ্ছা বঙ্গোপসাগরে একটা ঘাঁটি তৈরি করার, যেখান থেকে তাঁরা চিনের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। আবার ভারতও তাঁদের নিয়ন্ত্রণ কোনও ভাবেই হারাতে চাইছে না।
একইভাবে রাশিয়া পূর্ব প্রান্তে বাণিজ্য করতে হলে বঙ্গোপসাগরে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। তাই তো বঙ্গোপসাগর যার, আগামীদিনে তাঁরাই বিশ্ব বাণিজ্য দখলে রাখবে। এটা গেল ভূমিকা। এবার আসি আসল কথায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একটা সামরিক বেস তৈরি করতে। ভারতের আপত্তিকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা করতে দেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। ফলে তাঁকে গদিচ্যুত হতে হল। ভারতও আবার তাঁকে নিরাপদে বের করে নিয়ে এসে দিল্লিতে আশ্রয় দিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও পালাবদল হয়েছে, বাইডেন প্রশাসন গিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এসেছে। তবুও বাংলাদেশের কক্সবাজার বা সেন্ট মার্টিনের ওপর নজর সরায়নি আমেরিকা।
এবার আসা যাক ভারতের ভূমিকা। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পরিস্কার বলেছিলেন, ভারতের উপকূলের পরিমান সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটার। ফলে বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগরে ভারতের আধিপত্য প্রশ্নাতীত। তিনি আদতে বোঝাতে চেয়েছেন, ভারতকে বাদ দিয়ে এই মহাসাগরীয় এলাকায় কেউ আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না। বাংলাদেশের দিকে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন হাত বাড়িয়ে বসে আছে। চিনকে ঠেকাতে বাংলাদেশকে দরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, তেমনই চিন পাল্টা চাইছে বাংলাদেশকে কাছে পেতে। সেই সুযোগটাই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন মুহাম্মদ ইউনূস। এবার ভারতও কয়েকটি কড়া পদক্ষেপ নিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে সহজে ছেড়ে দেবে না ভারত। এস জয়শঙ্কর ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তাঁর ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য ছিল, “ভারতের থেকে বেশি বাংলাদেশের জন্য কেউ ভাবে না।
এটা ভারতের ডিএনএ-তে আছে”। ফলে বর্তমান বাংলাদেশের তদারকি সরকার যতই ভারতকে শত্রুভাবাপন্ন মনে করুক না কেন। ভারতকে দূরে রেখে তাঁরা তাঁদের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ করুক না কেন। বিপদে পড়লে সেই ভারতই বাঁচাবে। সেই কারণেই যখন মার্কিন উচ্চপদস্থ সেনাকর্তা জোয়েল পি ভোওয়েল ঢাকায় এসে মিয়ানমারে ঢোকার করিডোর চেয়ে বাংলাদেশ সেনার সঙ্গে বৈঠক করছেন। অন্যদিকে মুহাম্মদ ইউনূস চিনে গিয়ে চিনকেই আহ্বান জানিয়ে আসছেন। তখন ভারতও চুপ করে বসে নেই। বাংলাদেশকে ঘিরে নিয়ে সৈন সমাহার করেছে ভারত। সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র। যেমন এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমস, আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র, ব্রক্ষ্মস ক্ষেপণাস্ত্র-সহ আরও অনেক কিছু। অন্যদিকে রাশিয়ার যুদ্ধ জাহাজ চট্টগ্রামে পাঠিয়ে আমেরিকা ও চিনের মাঝে দাঁড় করিয়ে দিলেন নরেন্দ্র মোদি। সবমিলিয়ে বাংলাদেশকে ঘিরে বাড়তে থাকা ভূ-রাজনৈতিক উত্তাপ কিছুটা হলেও কমে যাবে বাংলাদেশে রাশিয়ার উপস্থিতিতে। এমনটাই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
Discussion about this post