প্রতি বছরই বন্যার জলে ডুবে যায় ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান। ভোট আসে ভোট যায়, ঘাটালবাসীর দুঃখ আর দুর্দশা রয়েই যায়। ১১ বছর ধরে তারকা সাংসদ দেব যেমন পারেননি,তেমনই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও ফেল করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাহলে কি ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে শুধুই ভোটের ঢপ হিসেবে থেকে গেল?
পশ্চিমবঙ্গের নবীন প্রজন্ম এবং যাদের জন্ম আশির দশকে সেই সমস্ত মানুষ প্রায় আজন্মই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কথা শুনে আসছেন। কিন্তু আজও তাঁর বাস্তবতা দেখতে পাননি। আর ঘাটাল ও আশেপাশের মানুষের পরিস্থিতি তো না বললেও আপনারা বুঝতে পারবেন। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান দক্ষিণবঙ্গের এক রহস্যময় পরিকল্পনা, যা আদৌ কোনও দিন বাস্তবায়িত হবে, এমন কথা কেউ আজ হলপ করে দাবি করতে পারে না। কারণ, এই মহাপরিকল্পনার প্রথম শিলান্যাস হয়েছিল সেই ১৯৮৩ সালে। এর ২৭ বছর পর রিপোর্ট জমা পড়ে। অর্থাৎ ৩৪ বছরের বাম জমানার প্রায় পুরো সময়কালই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান কাগজে কলমেই থেকে গিয়েছে। এরপর রাজ্যে পালাবদল হয়, ক্ষমতায় আসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। এরপর ১০ বছর তৃণমূল সরকার রাজ্য পরিচালনা করার পর ২০২১ সালে প্রথম ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। মজার বিষয় হল, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে ২০১৫ সালে প্রকল্প রিপোর্টে সবুজ সংকেত দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। তৃণমূল সরকার রাজনীতি করার দিকেই বেশি মন দিয়েছিল, ঘাটালবাসীর উপকার করার সদিচ্ছা হয়তো ছিল না। কারণ, আজকের দিনে দাঁড়িয়েও দক্ষিণবঙ্গের বন্যা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবং ডিভিসিকে দায়ী করলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মুখে ফিরে এল বহু ব্যবহারে ক্লিশ হয়ে যাওয়া সেই ‘ম্যান মেড’ বন্যার বুলি।
ফি বছর দ্বারকেশ্বর, গন্ধেশ্বরী, শিলাবতী, কংসাবতী-সহ সব নদীই বর্ষাকালে ফুঁসে ওঠে। ফলে দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলা ভেসে যায়। যার জেরে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় রাজ্যের তিন জেলা— বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামে। পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে সবচেয়ে ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়। ঘাটালবাসীদের অভিমান, প্রতি বছর নিয়ম করে এখানে বন্যা হয়, এভাবেই আমরা অভ্যস্থ হয়ে গেছি। তাই জল বাড়লেই আমরা জামা-প্যান্ট খুলে গামছা পড়ে চলাফেরা করি।
বিরোধীদের দাবি, প্রতি বছর ঘাটালে বন্যা পরিস্থিতি হলে শাসকদলের লাভ। ত্রাণ, ত্রিপলের ব্যবস্থা করতে কিছু আমদানি হয়। তাই বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয় না, বন্যা রোধের কোনও ব্যবস্থা হয় না। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসকও জানাচ্ছেন, ঘাটালবাসীর দুর্দশা দূর করতে প্রশাসন কি কি ব্যবস্থা নিয়েছে।
২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাটালের সাংসদ দেবকে পাশে নিয়েই ঘোষণা করেছিলেন, সেই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়িত হবে। ব্যাস, তারকা প্রার্থী দেব বিপুল ভোটে জিতে গেলেন আর ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানও হিমঘরে চলে গেল। অন্যদিকে বিজেপি বিধায়ক হিরণ চট্টোপাধ্যায় দাবি করলেন, মুখ্যমন্ত্রী ক্রমাগত মিথ্যা প্রচার করে চলেছেন। তিনি বলেন, ২০২২ সালেই ১২৩৮ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা কেন্দ্রীয় সরকার ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু জন্য বরাদ্দ করেছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সেটা চেপে যাচ্ছেন।
অপরদিকে রাজ্যের সেচমন্ত্রী মানস ভূঁইয়া দাবি করছেন, কেন্দ্রীয় সরকার কোনও টাকা বরাদ্দ করেনি। বরং বাংলার মুখ্যমন্ত্রীই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রুপায়িত করছেন। তিনি ইতিমধ্যেই ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন।
প্রতি বছর বন্যায় প্রায় ১৮ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ১৩টি ব্লকের ১ হাজার ৬৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। তার পরেও পরিস্থিতি বদলায় না। অথচ, রাজ্যের বাম শাসন থেকে শুরু করে তৃণমূল শাসন, সকলেই কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়ী করে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেছে। সামনেই বিধানসভা নির্বাচন। এবারও নিয়ম করে বন্যার জলে ডুবেছে ঘাটাল-সহ বিস্তৃর্ণ এলাকা। তাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছেন তিন বছরের মধ্যে শেষ হবে ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’। এই পরিকল্পনায় ১৩০ কিলোমিটার নদীর ড্রেজ়িং, বাঁধ নির্মাণ, ব্রিজ তৈরি, খাল কাটা, খালের সংস্কার, কৃত্রিম নদী তৈরি, জমি অধিগ্রহণের মতো বেশ কিছু কাজ করা হবে। ভোট বড় বালাই, তাই আসরে মুখ্যমন্ত্রী। এখন দেখার ঘাটালবাসীদের গামছা পড়ে বন্যার জলে নামতে হয় কিনা।
Discussion about this post