একুশের বিধানসভা ভোটের প্রচার থেকেই দিল্লির বিজেপি নেতাদের ‘বহিরাগত’ এবং বিজেপিকে ‘বাংলা বিরোধী’ বলে তোপ দেগে আসছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চব্বিশের লোকসভা ভোটেও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি। তবুও যেটা সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ছে সেটা হল এবারের ভোটে তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় তিন বহিরাগতের উপস্থিতি। আর এই তিনজনই এবার জিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে চওড়া হাসি ফিরিয়েছেন। তাঁরা হলেন, বর্ধমান-দূর্গাপুরে কীর্তি আজাদ, বহরমপুরে ইউসুফ পাঠান এবং আসানসোলে শত্রুঘ্ন সিনহা। তিনজনেরই জয়ের ব্যবধান চোখে পড়ার মতো।
ইউসুফ পাঠান এবং কীর্তি আজাদ ক্রিকেটের ময়দান থেকে এলেও শত্রুঘ্ন সিনহা বলিউডের প্রাক্তন তারকা। এরমধ্যে শত্রুঘ্ন এর আগেই আসানসোল লোকসভার উপনির্বাচনে জিতেছেন। কীর্তি আজাদও বিহারের দ্বারভাঙা আসনে জিতে দুবার সাংসদ হয়েছিলেন। কিন্তু ইউসুফ এবারই প্রথম ভোটে লড়লেন। ইউসুফ পাঠান গুজরাটের বরোদায় এক পাঠান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অনেক লড়াই করে তিনি এবং তাঁর ভাই ইরফান পাঠান জাতীয় ক্রিকেট দলে সুযোগ পান এবং দুই ভাই যথেষ্ট জনপ্রিয়াতাও পান। এহেন ইউসুফ পাঠানকে সুদূর গুজরাট থেকে কলকাতায় এনে ব্রিগেডের জনগর্জন সভা থেকে সোটা তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে চমক দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। তখন থেকেই বঙ্গ রাজনীতিতে চর্চা ছিল, বহরমপুরের ‘ডন’ অধীরের সামনে কতটা লড়াই করতে পারবেন ইউসুফ? ক্রিকেটের মাঠে বড় বড় ছক্কা হাঁকানো ইউসুফ রাজনীতিতে নিখাদ আনকোরা। অপরদিকে বঙ্গ বিজেপি এবার পাল্টা বহিরাগত তত্ত্ব সামনে এনে জোরদার প্রচার শুরু করেছিল বহরমপুর এবং বাকি দুই আসনে। তবুও ‘খেলা হবে’ স্লোগানকে সামনে রেখে ইউসুফ মাটি ধরালেন রাজনীতিতে পাহাড় প্রমান অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কংগ্রেসের অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে। প্রার্থী তালিকায় নাম আসার পরই বাক্স-প্যাটরা গুছিয়ে কলকাতায় আসেন ইউসুফ পাঠান, এরপর একটানা বহরমপুরে পড়ে থেকে দিন-রাত এক করে প্রচার করে গিয়েছেন। ফলে বিজেপি, কংগ্রেস ইউসুফ পাঠানকে যতই বহিরাগত বলে দেগছে, ততই জনসংযোগ বাড়িয়েছেন তিনি। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেছেন, প্রান্তিক এলাকায় মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন। ফলে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ অধীর ধরাশায়ী হলেন রাজনীতিতে নিতান্ত শিশু ইউসুফ পাঠানের কাছে।
অপরদিকে, শত্রুঘ্ন সিনহা এবং কীর্তি আজাদ আদতে বিহারের বাসিন্দা। দুজনেরই বিজেপি থেকে উত্থান। দুজনেই বিজেপির সাংসদ হয়েছিলেন। এরমধ্যে শত্রুঘ্ন সিনহা বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন। দুজনেরই তৃণমূলে আসার পথ প্রায় এক। বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করে কংগ্রেসের ‘হাত’ ধরা এবং পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের ‘হাত’ ছেড়ে তৃণমূলে আসা। কীর্তি আজাদ বিজেপির তরফে বিহারের দ্বারভাঙার সাংসদ ছিলেন। পরে কংগ্রেসে গিয়ে ওই আসন থেকেই হেরে যান। এরপরই কংগ্রেস ত্যাগ করে তৃণমূলে আসা। এবার বর্ধমান-দূর্গাপুরের মতো কঠিন আসনে তিনি লড়লেন বঙ্গ বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধে। তবুও ক্রিকেটের মতোই কঠিন পিচে শেষ পর্যন্ত দিলীপকে বোল্ড করে সংসদে যাওয়ার টিকিট হাতে পেলেন তৃণমূলের কীর্তি।
আসানসোলে বিজেপি প্রার্থী করেছিল প্রখ্যাত ভোজপুরী গায়ক পবন সিংকে। কিন্তু তৃমমূল তাঁকে বহিরাগত বলে রাজ্য তোলপাড় করেছিল। সেই আসানসোল আসনেই আবার তৃণমূলের প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিনহা। যদিও এ ক্ষেত্রে তৃমমূল নেতাদের বক্তব্য ছিল, শত্রুঘ্ন আগে থেকেই আসানসোলের সাংসদ। তিনি ২০২২ সালে উপনির্বাচনে জিতেছেন। তৃণমূলের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, যারা বাংলাকে কালিমালিপ্ত করছেন, বঞ্চনা করছেন, অপমান করছেন, তাঁরাই আসল বহিরাগত। তাই শত্রুঘ্ন, কীর্তি বা ইউসুফ সেই অর্থে বহিরাগত নয়। তিনজনই বাংলাকে ভালোবেসে এখানে এসেছেন এবং বাংলার উন্নতিকল্পে কাজ করতে চাইছেন। এই প্রচারেই বাজিমাৎ করল তৃণমূল। এবং উল্টো দিক থেকে বলা যায়, ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে তৃণমূলের তিন ‘বহিরাগত’ প্রার্থী বড় জয় উপহার দিলেন বাংলার শাসকদলকে।
Discussion about this post