গঙ্গাসাগর আজও অগণিত ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে এক মহা পুণ্যভূমি। হিমালয়ের কোল থেকে নেমে এসে পতিত পাবনী মা গঙ্গা উত্তর ও পূর্ব ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে উর্বরা করে এই গঙ্গাসাগরে এসেই সাগরে বিলীন হয়েছে। এটা তো গেল ভৌগোলিক দিক, গঙ্গাসাগরের বহু প্রাচীন এক ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক দিকও আছে। তাই যুগ যুগ ধরে গঙ্গাসাগর গোটা ভারতবর্ষের ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে এক মহা পুণ্যভূমি। প্রাচীনকাল থেকেই বিপদসঙ্কুল বহু পথ পেরিয়ে মুড়িগঙ্গার তীরে পৌঁছতে হতো পুন্যর্থীদের। এর পর বিশাল বুড়িগঙ্গা পার হওয়া একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। উত্তাল সেই নদী পেরিয়ে তবে সাগরদ্বীপের কচুবেড়িয়া গ্রাম। সেখান থেকে আবার গঙ্গাসাগরের কপিলমুনির আশ্রম। যতটা শুনতে ভালো লাগলো, এই পথ কিন্তু এতটা ভালো ছিল না মোটেই। পদে পদে বিপদ মাথায় নিয়ে পৌঁছতে হতো গঙ্গাসাগরে। তাই ক্রমে ক্রমে এই প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছিল, “সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার”। এই একবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও পথশ্রম একফোঁটাও কমেনি। কলকাতা থেকে ট্রেন বা বাসে কাকদ্বীপ, সেখান থেকে মুড়িগঙ্গায় ফেরিতে পার হয়ে কচুবেড়িয়া ঘাট। এই ফেরি সার্ভিসও জোয়ার-ভাঁটার ওপর নির্ভরশীল। এরপর কচুবেড়িয়া থেকে সড়কপথে গঙ্গাসাগর কপিলমুনির আশ্রম বা মন্দির। ফলে আজও প্রাচীন সেই বাংলা প্রবাদ সমীচীন। সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার।
তবে আর খুব বেশিদিন এই সমস্যা থাকবে না। কারণ এবার মুড়িগঙ্গার উপর সেতু নির্মাণের তোড়জোড় শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। লোকসভা ভোটের প্রচারে সাগরে এসে মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, গঙ্গাসাগর সেতু তৈরি করবে রাজ্য সরকার। তবে তিনি এও জানিয়েছিলেন, সেতু তৈরি করতে একটু সময় লাগবে। তবে সেতু তৈরির জন্য সার্ভে করে ডিপিআর তৈরি হয়ে গিয়েছে। আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলেই দাবি করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর ফলে তীর্থযাত্রীদের যাত্রা আরও সহজ হবে।
কথা রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী। লোকসভা ভোট মিটতেই গঙ্গাসাগর সেতু তৈরিতে তৎপরতা শুরু করল রাজ্য সরকার। এর জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। আমরা জানি, পশ্চিমবঙ্গে জমি অধিগ্রহণ একটা বড় সমস্যা। অতীতে বহু কাজ দীর্ঘদিন আটকে ছিল বা এখনও আটকে রয়েছে এই জমিজটের কারণে। কিন্তু গঙ্গাসাগর সেতুর কাজ যে জমি সমস্যায় আটকাবে না, সেটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। কারণ, স্থানীয় মানুষজন স্বেচ্ছায় নিজেদের জমি দিতে তৈরি। তাঁরা নিজেরাই দীর্ঘকাল ধরে কাকদ্বীপ ও কচুবেড়িয়ার মধ্যে মুড়িগঙ্গা নদীর উপর সেতু তৈরির দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এবার রাজ্য সরকার সেতু তৈরির উদ্যোগ নিতেই তাঁরা সাগ্রহে জমি দিতে এগিয়ে আসছেন। সূত্রের খবর, সাগরদ্বীপের একশোর বেশি বাসিন্দা জমি দিতে রাজি হয়েছেন।
প্রস্তাবিত গঙ্গাসাগর সেতুর জন্য কাকদ্বীপ এবং সাগরদ্বীপে মোট ১২ একর জমির প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে কিছু জমি সরকারি মালিকানাধীন হলেও অধিকাংশ জমিই হল ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। সূত্রের খবর, গত সোমবার জমির মালিকদের সঙ্গে সাগর ব্লক প্রশাসনের বৈঠক হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী বঙ্কিমচন্দ্র হাজরাও। ওই বৈঠকেই একশো জনের বেশি জমির মালিক স্বেচ্ছায় জমি দিতে রাজি হয়েছেন। ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকার ক্ষতিপূরণের হিসেব কষে ফেলেছে। জানা যাচ্ছে ক্ষতিপূরণ বাবদ ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে প্রাথমিকভাবে। এবার জমি অধিগ্রহণ পর্ব শুরু হবে। তবে প্রস্তাবিত সেতুর এলাকায় দুটি পানের বরজ এবং কয়েকটি বসতবাড়ি পড়ছে। সেগুলি অন্যত্র সরাতে হবে। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই জমি দিতে রাজি হওয়ায় জমিজটে গঙ্গাসাগর সেতু নির্মাণ থমকে যাবে না বলেই মত প্রশাসনের।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রের খবর, গঙ্গাসাগর মেলার সময়ে কচুবেড়িয়ায় যে অস্থায়ী ৪ নম্বর জেটি ঘাট তৈরি করা হয়। সেই জেটি ঘাটের উপর দিয়ে ব্রিজের ঢাল নেমে সোজা যাবে আশ্রম মোড় পর্যন্ত। অন্য দিকে, কাকদ্বীপের ৮ নম্বর লটের ৪ নম্বর স্থায়ী ভেসেল ঘাট দিয়ে ব্রিজের ঢাল গিয়ে পৌঁছবে কাকদ্বীপ শহরের গোলপার্ক পর্যন্ত। অর্থাৎ, কাকদ্বীপের লট ৮ থেকে কচুড়িয়া পর্যন্ত মুড়িগঙ্গা নদীর উপর সেতুটির দৈর্ঘ্য হবে ৩.১ কিলোমিটার। তবে দুই পারের ঢাল মিলিয়ে সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য হবে ৪.৭ কিলোমিটার। ২০২৫ সালের গঙ্গাসাগর মেলা উদ্বোধণের দিনই এই প্রস্তাবিত গঙ্গাসাগর সেতুর শিলান্যাস করতে চান মুখ্যমন্ত্রী। প্রসঙ্গত, মুড়িগঙ্গা নদীর উপর সেতু তৈরির প্রস্তাব কয়েক দশকের। কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্য টানাপোড়েনে এই সেতুর কাজ শুরুই করা যায়নি। রাজ্যের দাবি, কেন্দ্রীয় সরকার এই দীর্ঘ সেতুর জন্য অর্থ বরাদ্দ করছে না। অপরদিকে কেন্দ্রের তরফে রাজ্যের অসহযোগীতার দাবি তোলা হচ্ছে। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুড়িগঙ্গার উপর গঙ্গাসাগর যাওয়ার সেতু তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। রাজ্য সরকার নিজের খরচেই এই সেতু তৈরি করবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। এবার সেই কাজ শুরু হওয়ায় খুশি পর্যটক, তীর্থযাত্রী থেকে শুরু করে সাগরদ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দারাও।
Discussion about this post